মধ্যপ্রাচ্যের আকাশে তখন বারুদের গন্ধ। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর, হামাসের আকস্মিক আক্রমণ আর গাজায় ইসরাইলের ভয়াবহ পাল্টা অভিযান পুরো অঞ্চলে আগুন লাগিয়ে দিলো। আর এই আগুনের আঁচেই বদলে গেল রিয়াদ-তেহরান সম্পর্কের গল্প, যে গল্প যেন রোমাঞ্চকর কোনো রাজনৈতিক থ্রিলার!
এ বিষয়ে ফিনান্সিয়াল টাইমসে সাউদি আরাবিয়া স্টিকস উইথ ইরান আফটার ইসারাইল ওয়ার শীর্ষক প্রতিবেদন যৌথভাবে করেছেন, জেদ্দা থেকে আহমেদ ওমরান এবং দুবাই থেকে চোলে কর্ননিশ। লন্ডন থেকে অ্যান্ড্রু ইংল্যান্ড এবং তেল আবিব থেকে নেরি জিলবারও তাদের সাথে ছিলেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু আর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের তখন স্বপ্ন, আরব দেশগুলোকে একে একে ইসরাইলের সাথে মেলানো। নেতানিয়াহু নিজেই বলেন, ‘সৌদি আরবসহ অন্যদের সাথে কিভাবে শান্তি আনতে হবে, আমাকে ছেড়ে দিন। শুধু ভেবে রাখিনি, এখনো ভাবছি।’
ইঙ্গিত স্পষ্ট, ইসরাইল-সৌদি সম্পর্কের ঐতিহাসিক মেলবন্ধন আর বেশি দূরে নয়।
কিন্তু গল্পে মোড় নেয় গাজায় যুদ্ধের বিভীষিকা দেখে। সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান সংক্ষেপে এমবিএস ইসরাইলের রক্তাক্ত অভিযান দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন। তিনি বুঝে যান, মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে নতুন অধ্যায় লিখতে গেলে, তাকে রিয়াদ-তেহরানের শতাব্দীর শত্রুতা ভুলে যেতে হবে। তাই দ্রুত গতি পায় ইরানের সাথে পুনর্মিলনের পথচলা।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ইসরাইলের এই হিংস্র অভিযান সৌদি আরবের কাছে ইসরাইলকে আরো ভয়ঙ্কর ও অস্থিতিশীল শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করেছে। যুদ্ধের পর সৌদি আরব একের পর এক পদক্ষেপ নিয়ে প্রকাশ্যে তেহরানের সাথে সম্পর্ক জোরদার করতে থাকে। সৌদি সরকারের চিন্তা-ভাবনার সাথে ঘনিষ্ঠ একজন বলেন, ‘সবচেয়ে বড় প্রতিবেশীর সাথে সুসম্পর্ক রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ। তবে এতে ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার সম্ভাবনা কমে যাচ্ছে আর ফিলিস্তিন নিয়ে সৌদির অবস্থান আরো কঠিন হচ্ছে।’
বাহরাইনের আন্তর্জাতিক কৌশলগত গবেষণা প্রতিষ্ঠানের হাসান আলহাসান বলেন, ‘এখন ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে গেলে দেশটি ভেতরে এবং ইসলামি দুনিয়ায় নেতৃত্বের ক্ষেত্রে সৌদি আরবের মর্যাদার ক্ষতিটি হবে অনেক বড়।’
৭ অক্টোবরের আগেই এমবিএসের দৃষ্টিতে ছিল এক চমকপ্রদ লক্ষ্য। তিনি চেয়েছিলেন ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করবে, বিনিময়ে মার্কিন প্রতিরক্ষা চুক্তি বর্তাবে রিয়াদের ভাগ্যে। এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্রই বদলে যাবে। ওই সময় রিয়াদের আকাশে শোভা পেত বিশাল বিলবোর্ড, যেখানে ডোনাল্ড ট্রাম্প আর এমবিএস হাত মেলাচ্ছেন, উপরে লেখা ‘আমরা মানে ইসরাইল প্রস্তুত।’
এই প্রচেষ্টা সৌদিদের জন্য ওয়াশিংটনের রাজনৈতিক আশীর্বাদ বয়ে আনতে পারত। ট্রাম্পও সৌদি আরবকে আব্রাহাম চুক্তিতে আনার তার ‘স্বপ্ন’ কথা গোপন রাখেননি। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাহরাইন ২০২০ সালে ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করলেও অনেকের চোখে মুসলমান বিশ্বের নেতা সৌদি আরবের সাথে এমন সমঝোতা ইসরাইলের জন্য বিশাল জয় হতো।
কিন্তু গাজায় রক্তগঙ্গার পর যুবরাজ এমবিএস ইসরাইলের অভিযানকে ‘গণহত্যা’ বলেই বারবার নিন্দা করলেন। পারস্য উপসাগরীয় কর্মকর্তাদের শঙ্কা ছিল, গাজার ধ্বংসের ছবি দেখে নতুন প্রজন্মের মনে ঘৃণা জন্মাবে। আর সেই প্রজন্মই যুবরাজের ‘ভিশন ২০৩০’ অর্থনৈতিক রূপান্তরের কেন্দ্রে রয়েছে। ফলে এমবিএসের শর্ত পরিষ্কার হয়ে যায়। তিনি উচ্চকণ্ঠেই বললেন, যুদ্ধবিরতি আর ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় বাস্তব অগ্রগতি ছাড়া কোনো স্বাভাবিক সম্পর্ক নয়।
যুদ্ধ যখন মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিটি প্রান্তে কম্পন তোলে, তখন রিয়াদ-তেহরান সম্পর্কের গল্প এক নতুন মোড় নেয়। বছরের পর বছর সুন্নি সৌদি আরব আর শিয়া ইরান শত্রুতার বাঁধনে আবদ্ধ ছিল। লেবানন, ইয়েমেনের মতো দেশগুলোয় ইরানি প্রোক্সি গোষ্ঠীগুলোকে অস্থিতিশীলতার উৎস ভাবতরিয়াদ। কিন্তু ২০১৯ সালে পারস্য উপসাগরীয় জ্বালানি স্থাপনায় হামলার পর, যে হামলার জন্য ইরানকে দায়ী করা হয়, তখন যুক্তরাষ্ট্রের ঠান্ডা প্রতিক্রিয়ায় হতাশ সৌদি আরব কৌশল বদলায়। ২০২৩ সালের মার্চে ইরান-সৌদি আরব দু’দেশের সম্পর্ক পুনঃস্থাপন হয়।
সেই থেকে এমবিএস আর ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ান ফোনে নিয়মিত কথা বলছেন। দু’দেশের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারাও বৈঠক করছেন। কারণ সৌদি আরব কোনোভাবে আঞ্চলিক সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়তে চায় না।
বিশ্বের চোখের সামনে এক নাটকীয় দৃশ্য শুরু হলো। ২০২৫ সালের ১৭ এপ্রিল তেহরানে ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর চিফ অব স্টাফ মেজর-জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি সৌদি প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রিন্স খালিদ বিন সালমানকে সশরীরে স্বাগত জানান। জুনে ইসরাইলি বিমান হামলায় শহীদ হওয়ার আগে বাঘেরিই ছিলেন ইরানের শীর্ষ সামরিক নেতা। এ সফরে ইরানের শীর্ষ নেতা আয়াতুল্লালাহিল উজমা খামেনির সাথেও দেখা করেন তিনি।
সৌদি আরব ইসরাইলের হামলাগুলোর তীব্র নিন্দা জানায়, আর সৌদি প্রতিরক্ষামন্ত্রী খালিদ ইরানের নতুন সামরিক প্রধান আব্দোরাহিম মৌসাভির সাথে ফোনে কথা বলেন ‘নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা রক্ষার প্রচেষ্টা’ নিয়ে।
যুদ্ধের আরেকটি অদ্ভুত সত্য হলো, ইসরাইলে আগ্রাসনে ইরান ও তার প্রোক্সি গোষ্ঠী যেমন হিজবুল্লাহ দুর্বল হলেও তেহরান এখন সৌদির কাছে তত বড় হুমকি মনে হচ্ছে না। তবে শঙ্কা বেড়েছে, ইরান হয়তো আগের চেয়ে আরো বেশি করে পরমাণু অস্ত্রের পথে হাঁটবে। এদিকে ইসরাইলের চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধের ফলে ইরানের অর্জনের নিয়ে নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন ইরানের বিপ্লবী রক্ষী বাহিনী বা আইআরজিসির সাবেক কর্নেল শাহবাজি।
ঐতিহাসিক শাহরে রেই থেকে দেয়া টেলিফোন সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ইরানের পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলো তেহরানের সাথে সম্পর্ক জোরদার করছে। তারা এখন ইরানি বিনিয়োগের ভাবনা-চিন্তাও করছে।
এদিকে মধ্যপ্রাচ্য ইনস্টিটিউটে ভিজিটিং স্কলার গ্রেগরি গাউস বলেন, ‘২০২২ সালের ইরান আর ২০২৫ সালের ইরান এক নয়। আর ২০২৫ সালের বিজয়ী ইসরাইল এখন অঞ্চলের রাজনীতিতে সবচেয়ে অস্থিতিশীল শক্তি।’
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও থেমে নেই। তিনি ফক্স নিউজকে বললেন, ‘যুদ্ধের পর আরো দেশ আব্রাহাম চুক্তিতে যোগ দেবে, কারণ ইরানই ছিল প্রধান সমস্যা।’
ইসরাইলি কর্মকর্তারা মনে করছেন, সৌদির সাথে পূর্ণ স্বাভাবিক সম্পর্কের চেয়ে সহজ হতে পারে ‘যুদ্ধ নয়’ নিরাপত্তা চুক্তি, যেমন সিরিয়ার নতুন সরকার আহমেদ আল-শারার সাথে হয়েছে।
কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্পকে খুশি রাখতে উপসাগরীয় দেশগুলো অর্থনীতির পথেই বাজি ধরছে। মে মাসে ট্রাম্পের সফরে ট্রিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি আসে। এভাবে যেতে যুক্তরাষ্ট্রের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও অত্যাধুনিক অস্ত্র প্রযুক্তি হাতে পাওয়া যায়।
হাসান আলহাসান বলেন, ‘ট্রাম্পের মতো সৌদিরা সময়ের চাপে নেই। তারা যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী অবস্থানে আছে, তাই তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করতে হবে না।’
এভাবেই মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধের ডামাডোলের আর বোমার ধোঁয়ার আড়ালে গোপন এক রোমাঞ্চের গল্প বোনা হচ্ছে। যেখানে যুদ্ধ, কূটনীতি আর অর্থনৈতিক স্বার্থ মিলে রিয়াদ-তেহরান সম্পর্ককে দিচ্ছে নতুন ব্যাখ্যা। ইতিহাসের পাতায় এখনো সেই গল্পের শেষ পঙতি লেখা হয়নি।