ইরান আবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। এবার কারণ একাধিক আন্তর্জাতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশটি চীন থেকে হাজার হাজার টন ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির কাঁচামালের ক্রয়াদেশ দিয়েছে। বিষয়টি যেমন আন্তর্জাতিক উদ্বেগ তৈরি করেছে, তেমনি প্রশ্নও তুলেছে যে ইরান কি যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে না কেবল আত্মরক্ষার শক্তি বাড়াচ্ছে?
দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল দাবি করেছে, ইরানের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘রাফি নভিন ট্রেড পাইওনিয়ারস’ হংকংভিত্তিক ‘লায়ন কমোডিটিজ হোল্ডিংস’ থেকে ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণের কাঁচামালের ক্রয়াদেশ দিয়েছে। এই কাঁচামালের মধ্যে রয়েছে ‘অ্যামোনিয়াম পারক্লোরেট’—যা শত শত ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র চালাতে পারে এমন শক্তিশালী জ্বালানির একটি রাসায়নিক উপাদান। এ সংক্রান্ত মন্তব্যের জন্য কোম্পানির পরিচালক নেলসন বারবা এবং ইরানি কোম্পানির সাথে টেলিফোনে যোগাযোগের ব্যর্থ চেষ্টাও করা হয়েছে।
ইরানের অন্যতম জনপ্রিয় দৈনিক হামশাহরি অনলাইন দেশটির ইয়ং জার্নালিস্ট ক্লাবের আজম পুরকান্দের বরাত দিয়ে এ খবর দিয়েছে।
সূত্রের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, এই রাসায়নিক উপদানের খানিক অংশ ইরানের মিত্রদের কাছেও পাঠানো হতে পারে। ইরান এখন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে গভীর আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। ঠিক এই সময়েই এমন সামরিক প্রস্তুতির তথ্য সামনে এসেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিষয়টি নিয়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে ফোনালাপে আলোচনা করেছেন বলেও জানা গেছে।
চীনের পক্ষ থেকে অবশ্য এমন কোনো লেনদেনের কথা অস্বীকার করা হয়েছে। বেইজিং জানিয়েছে, তারা সামরিক এবং বেসামরিক বা দ্বৈত ব্যবহারযোগ্য পণ্যের রফতানিতে আন্তর্জাতিক আইনের কঠোর নিয়ন্ত্রণ মেনে চলে।
এই প্রসঙ্গে একটু বুঝে নেয়া যাক ব্যালেস্টিক এবং ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের মধ্যে পার্থক্য কী? ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র মূলত নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে উচ্চ গতিতে আঘাত হানার জন্য নিক্ষেপ করা হয়। এটি ভূমি থেকে উৎক্ষেপণের পর বায়ুমণ্ডলের বাইরের কক্ষপথে উঠে যায়। বায়ুমণ্ডলে ঢোকার পরে মাধ্যাকর্ষণ টান ও গতি অনুযায়ী লক্ষ্যবস্তুর দিকে ধেয়ে যায়। এ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রের গতি অত্যন্ত বেশি এবং দূরপাল্লার পথ পাড়ি দিয়ে শত্রু স্থাপনার ওপর আঘাত হানতে সক্ষম।
অন্যদিকে, ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র বায়ুমণ্ডলের ভেতরে থেকেই অপেক্ষাকৃত নিচু উচ্চতা দিয়ে উড়ে যায়। এ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র সাধারণত টার্বোফ্যান বা জেট ইঞ্জিনের শক্তিতে ধেয়ে চলে। এগুলো মাটির খুব কাছাকাছি দিয়ে উড়ে গিয়ে শত্রু রাডারে শ্যেন চক্ষু ফাঁকি দিয়ে লক্ষ্যবস্তুতে নিখুঁতভাবে আঘাত হানতে পারে।
ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি নতুন নয়। ১৯৮০–৮৮ সালের ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় থেকেই তারা ক্ষেপণাস্ত্র উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দেয়। তখন থেকেই তারা ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি অর্জন ও উন্নত করার চেষ্টা করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন, উত্তর কোরিয়া এবং পরবর্তীতে চীন থেকে প্রযুক্তি সহায়তা নিয়ে তেহরান নিজস্ব উৎপাদন শুরু করে।
বর্তমানে ইরান মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম বৃহৎ ক্ষেপণাস্ত্র শক্তিতে পরিণত হয়েছে। তাদের কাছে রয়েছে ‘শাহাব’, ‘গ্বাদির’, ‘সনজিল’ এবং ‘খোররামশাহর’ নামের ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। এসব ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা কয়েক শ’ থেকে দুই হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত। বোমা বা ওয়ারহেডের ওজন কমিয়ে এবং বাড়তি জ্বালানি নিয়ে এসব ক্ষেপণাস্ত্রের কোনো কোনোটার পাল্লা আরো বাড়ান সম্ভব বলে রণবিদরা মনে করেন।
ইরান বলছে, তাদের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি সম্পূর্ণ আত্মরক্ষামূলক এবং প্রতিরোধমূলক। জাতিসঙ্ঘ সনদের ৫১ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রতিটি সার্বভৌম রাষ্ট্রেরই আত্মরক্ষার অধিকার আছে।
তবে আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলো মনে করে, ইরান নিজ মিত্রদের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তারে এই সামরিক শক্তি ব্যবহার করতে পারে। ইসরাইল এবং সৌদি আরবও ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচিকে হুমকি হিসেবে দেখে।
তবে ইরান বারবার বলেছে, তারা প্রতিরোধ আন্দোলনগুলোকে কূটনৈতিক এবং রাজনৈতিক সহায়তা দিলেও সরাসরি ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহের কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ কেউ দিতে পারেনি। তাদের মতে, এই অভিযোগগুলো ইরান আতঙ্ক বা ইরানবিদ্বেষ ছড়ানোর এবং বাড়ানোর মতলব মাত্র।
ইরান ও চীনের মধ্যে কাঁচামাল বা শিল্পজাত দ্রব্য আমদানি-রফতানির যে সম্পর্ক, তা তাদের বৈধ অর্থনৈতিক সম্পর্কেরই অংশ বলে দাবি করছে তেহরান। তবে যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা নিষেধাজ্ঞা এবং কিছু জাহাজ আটকের ঘটনা আবার এই লেনদেনকে সন্দেহের চোখে দেখার অবকাশ তৈরি করছে। আন্তর্জাতিক পানিসীমায় কিছু ইরানি বা চীনা জাহাজ আটক করার ঘটনা সমুদ্র আইন ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চুক্তির লঙ্ঘন বলেও উল্লেখ করেছে ইরান।
ইরান বলছে, তারা আন্তর্জাতিক আইন মেনেই প্রতিরক্ষামূলক সক্ষমতা বাড়াচ্ছে। পশ্চিম এশিয়ায় স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা রক্ষায় এটি একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ।
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, এত বড় মাপে ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির কাঁচামাল কেনা কি কেবল আত্মরক্ষার প্রয়োজনে? নাকি এটি কোনো বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক কৌশলের অংশ?
বিশ্ব এখন তাকিয়ে আছে তেহরান, বেইজিং এবং ওয়াশিংটনের পরবর্তী পদক্ষেপের দিকে। কারণ এই লেনদেনের ভবিষ্যৎ শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, গোটা বিশ্বের কৌশলগত সমীকরণকে প্রভাবিত করতে পারে।