এক মাস ধরে কঠোর সেন্সরশিপ ও তথ্য গোপনের পর ইসরাইলি চ্যানেল-১৩ সম্প্রতি ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরাইলের বৃহৎ তেল পরিশোধন কেন্দ্র হাইফার বাজান তেলশোধনাগারে ঘটে যাওয়া সেই ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞের কিছু অংশ সম্প্রচার করেছে।
ইরানি দৈনিক হামশাহরি অনলাইন দেশটির ফার্সি দৈনিক কায়হানের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, চ্যানেল-১৩ তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ‘যুদ্ধের ছায়ায় শুরু থেকেই তেলশোধনাগারের আগুন ও ক্ষয়ক্ষতির খবর গোপন রাখা হয়েছিল। অথচ, এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রই ছিল সব শিল্পকারখানার বিদ্যুৎ সরবরাহের উৎস। এই যে সামনে দুটি চিমনি দেখা যাচ্ছে, সেগুলো ছিল স্টিম বয়লারের অংশ। এক কথায় পুরো কারখানার প্রাণ।’
ক্যামেরায় দেখা গেছে, তিন দিক থেকে আঘাত লেগে সম্পূর্ণ বিকল হয়ে গেছে বাজান রিফাইনারি। এটাই ছিল ইসরাইলের দুটি রিফাইনারির একটি। এখানেই উৎপাদন হতো গ্যাসোলিন, ডিজেল, জেট ফুয়েল এমনকি বাসাবাড়ির রান্নার গ্যাসও।
ঘটনার আগের দিনই পরিবেশ-বিষয়ক মন্ত্রী এসেছিলেন এই কারখানায়। একজন কর্মী তাকে বলেছিলেন, ‘এখানে একটা সরাসরি আঘাত হলে কী হতে পারে তা আমি তাকে বলেছিলাম। আমি বলেছিলাম, শত্রু ঠিকই জানে কোথায় আঘাত করতে হবে। দুইটি লক্ষ্য থাকবে, পরিবেশ দূষণ আর ভয়াবহ আগুন। ঠিক পরদিন সেটাই হলো।’
একটিমাত্র ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাত, এক মুহূর্তেই স্তব্ধ হয়ে গেল গোটা তেলশোধনাগার। বিদ্যুৎ নেই, স্টিম নেই, উৎপাদন নেই। বাজান এখন কার্যত মৃত। কিন্তু ধ্বংসটা শুধু হাইফার কারখানায় সীমাবদ্ধ থাকেনি। এই বিস্ফোরণের শব্দ পৌঁছে গেছে জেরুসালেমের মন্ত্রিসভার বৈঠকঘরেও।
রিফাইনারি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে গোটা অঞ্চল। চারপাশে বাতাসে ভাসছে ধোঁয়াশার মতো বিষাক্ত গন্ধ। বাতাসের গতিপথ এমনভাবে চলাচল করে যে আশপাশের পুরো মহানগরীর এক মিলিয়ন বা দশ লাখের বেশি ইসরাইলি বিপদের মুখে বসবাস করছে। স্থানীয়রা সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ফোন করে জানাচ্ছেন চোখ জ্বালা করছে, হঠাৎ তীব্র গন্ধে শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। ইসরাইলের জ্বালানি মন্ত্রণালয় সতর্ক করেছে, ‘যদি দ্রুত মেরামত না করা হয়, তাহলে অ্যাম্বুলেন্স, ফ্রিজিং ট্রাক, বাস এমনকি সেনাবাহিনীর ট্রাকগুলোর জন্যও জ্বালানি থাকবে না।’
এখন পরিস্থিতি এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যেখানে একটাই প্রশ্ন- ইসরাইল কি কয়েক শত মিলিয়ন শেকেল খরচ করে মাসের পর মাস ধরে এই রিফাইনারি মেরামত করবে? নাকি সরকারের সিদ্ধান্ত মেনে সরিয়ে ফেলবে সবকিছু?
সংকট থেকে সাময়িক রক্ষার জন্য জরুরি জ্বালানি মজুদ আছে, যা কয়েকদিন চালিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ বলছে, এই পরিকল্পনা দীর্ঘমেয়াদে টিকবে না। আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা বা আরেকটি যুদ্ধ হলে বাহ্যিক উৎস থেকে জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে ইসরাইলের নিজস্ব উৎপাদন চালু রাখা অনিবার্য।
তবে ঘটনাপ্রবাহ এখানেই শেষ নয়। নতুন সমস্যা দেখা দিয়েছে বন্দরেই। বাজান তেলশোধনাগার মেরামতের জন্য ২০০ টন পাইপ নিয়ে একটি জাহাজ এসে পৌঁছায় হাইফা বন্দরে। জাহাজটির মালামাল জরুরি বলে চিহ্নিত ছিল। অথচ, হাইফা বন্দর কর্তৃপক্ষ তা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়। ফলে জাহাজটিকে পাশের একটি ইসরাইলি জাহাজঘাটে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। পাইপগুলো কী পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তার আভাস এখান থেকে মিলছে। ২০০ টন মানে প্রায় দুই কিলোমিটারের বেশি পাইপ। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে শোধনাগারের ভেতরে অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপকতা।
সেই সময় হাইফা বন্দরে মাত্র তিনটি জাহাজ অপেক্ষমান ছিল পণ্য খালাসের জন্য। বন্দরের নিয়ম অনুযায়ী, এই জরুরি পণ্যবাহী জাহাজকে অগ্রাধিকার দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা ভয়াবহ জনবলের সংকটে ভুগছে এবং জাহাজটিকে তারা গ্রহণ করতে পারবে না। তাই পাঠিয়ে দেয়া হয় অন্য এক ঘাটে, যেখানে আগে থেকেই খালাসের জন্য অপেক্ষায় রয়েছে ৩৮টি জাহাজ।
যদিও পাশের বন্দর পাঁচটি বার্থে একসাথে কাজ করে এবং রাতের শিফটে খালাসও শুরু হয়, তা সত্ত্বেও অনেক আমদানিকারক ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। প্রশ্ন উঠেছে, ৩৮টি জাহাজকে দেরি করিয়ে দেয়া হচ্ছে কেন? হাইফা বন্দর কি কর্মী বাড়াতে পারে না? আরো অভিযোগ, হাইফা বন্দর এখন অত্যাবশ্যকীয় পণ্য যেমন চাল, লোহা ও জ্বালানির পরিবর্তে গাড়ির কনটেইনার মজুত করছে, কারণ গাড়ি রাখা বেশি লাভজনক।
বন্দর কর্তৃপক্ষ আবার সরকারকে বলছে, ঋণ শোধ করতে পারে সে জন্য তাদেরকে একটি তহবিল থেকে যেন ২.৮ বিলিয়ন শেকেল তুলে নিতে দেয়া হয়।
এই সমগ্র ঘটনার ভেতর দিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠছে একটি বিষয়, ইরানের একটি ক্ষেপণাস্ত্র কেবল একটি তেলশোধনাগার নয়, বরং পুরো ইসরাইল রাষ্ট্রের জ্বালানি অবকাঠামো, পরিবেশ ও প্রশাসনিক ব্যর্থতাকেও উন্মোচিত করে দিয়েছে। আর এই আগুনে এখন শুধু তেল নয়, পুড়ছে গোপন করা বহু সত্যও।