গাজায় ইসরাইলের ‘নীতিবান বাহিনীর’ ভয়াবহ নৃশংসতা

আগস্টের শুরুর দিকে বিবিসি একটি জরিপ চালায়। সেখানে শিশুহত্যার ১৬০টি মামলার তদন্ত করা হয়। এর মধ্যে ৯৫টি মামলা এমন পাওয়া যায়, যেখানে কেবল আহত করার জন্য গুলি করা হয়েছে, এমন কথা বলার সুযোগ নেই।

নয়া দিগন্ত অনলাইন
গাজায় ইসরাইলি বাহিনী
গাজায় ইসরাইলি বাহিনী |সংগৃহীত

ইসরাইলি সেনাবাহিনী নিজেদেরকে বিশ্বের সবচেয়ে ‘নীতিবান সেনাবাহিনী’ হিসেবে দাবি করে থাকে। কিন্তু ইসরাইলি বিশ্লেষক ও গাজায় স্বাস্থ্যসেবায় অংশ নেয়া চিকিৎসকদের তথ্য অনুসারে, তারা গাজায় নিয়মিত যুদ্ধাপরাধ করে যাচ্ছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, গাজায় মারধর, গণহত্যা কিংবা নির্বিচারে গ্রেফতার এখন ইসরাইলি বাহিনীর জন্য নতুন কিছু নয়। মানবাধিকার লঙ্ঘনের দীর্ঘ প্রতিক্রিয়া, সেনাবাহিনীতে অতিডানপন্থী মতাদর্শীদের অন্তর্ভুক্তি এবং জবাবদিহিতার অভাব তাদেরকে এমন এক প্রেক্ষাপটে দাঁড় করিয়েছে, যেখানে তারা কোনো প্রয়োজন ছাড়াই যেকোনো ধরনের অভিযান চালাতে পারে।

এমস্টারডেম ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এরিলা গ্রাশিয়ানি ২০০০ সালের দ্বিতীয় ইন্তেফাদার সময় ইসরাইলি সেনাবাহিনীর নৈতিক অবক্ষয় নিয়ে অনেক লিখেছেন। তিনি বর্তমান ইসরাইলি বাহিনী সম্পর্কে বলেন, আমার যতদূর মনে হচ্ছে, বর্তমান বিষয়টি ইসরাইলি সেনাবাহিনীর ইতিহাসে নতুন রেকর্ড হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। কারণ, আগে শিশুরা পাথর নিক্ষেপ করতো বলে ইসরাইলি সেনারা তাদের মারধর কিংবা গ্রেফতার করতো। কিন্তু বর্তমানে তো এমনটি হয় না। সেজন্য এটিকে নতুন বিষয় হিসেবেই চিহ্নিত করতে হবে।

তিনি আরো বলেন, আগে যুদ্ধের একটা নিয়ম ছিল। সেগুলো কিছুটা হলেও অনুসরণও করা হতো। কিন্তু এখন, এখনকার পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখন কোনো নিয়মেরই তোয়াক্কা করা হয় না।

যুদ্ধ নয়, যেন হাতেকলমে প্রশিক্ষণ

গাজা ও অধিকৃত পশ্চিমতীরে দীর্ঘদিন ধরেই বর্বরতা চালিয়ে আসছে ইসরাইলিরা। সেখানে তারা একঘেয়েমি ভাব দূর করার জন্য সাধারণ নাগরিকদের গুলি করে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের টার্গেট অনুশীলন করার জন্যও বেসামরিক নাগরিকদের লক্ষ্য করা হতো। এছাড়া যেসব বাড়িতে অভিযান চালানো হতো, তাদের নারীদের পোশাক ও অন্তর্বাস নিয়েও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভিডিও পোস্ট করতো।

আগস্টের শুরুর দিকে বিবিসি একটি জরিপ চালায়। সেখানে শিশুহত্যার ১৬০টি মামলার তদন্ত করা হয়। এর মধ্যে ৯৫টি মামলা এমন পাওয়া যায়, যেখানে কেবল আহত করার জন্য মাথায় বা বুকে গুলি করা হয়েছে, এমন কথা বলার সুযোগ নেই।

এছাড়া মার্কিন সমর্থিত ও ইসরাইলি সেনাদের নিয়ন্ত্রিত ত্রাণ সংস্থা জিএইচএফ পরিচালিত ত্রাণ বিতরণী স্থানগুলোতে জড়ো হওয়া বেসামরিক নাগরিকদের লক্ষ্য করেও গুলি চালাতে দেখা গেছে ইসরাইলি বাহিনীকে। সেখানেও কেবল টার্গেট ঠিক করার অনুশীলনের জন্য এসব হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে তারা।

ব্রিটিশ সার্জন নিক মেনার্ড গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত তিনবার উপত্যকায় ভ্রমণ করেছেন। তিনি আল জাজিরাকে নিজ অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে গিয়ে বলেন, মূলত জিএইচএফ সাইটগুলো মৃত্যুর ফাঁদ হিসেবে তৈরি করা হয়েছে।

এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, এসব ত্রাণবিতরণী স্থানে যে খাবার দেয়া হয়, তা একটি পরিবারের কয়েক দিনের জন্য যথেষ্ট হয়। কিন্তু যারা সেখানে উপস্থিত হয়, সবাইকে সংস্থাটি ত্রাণ দেয় না। বরং অল্প কিছু মানুষের খাবার সেখানে রাখা হয়। এটি হুড়োহুড়ি করে ছিনিয়ে নিতে হয়। যেহেতু হাজার হাজার মানুষ ত্রাণের জন্য একত্রিত হয় এবং খাবারের জন্যও হুড়োহুড়ি করতে হয়, সেজন্য স্বভাবতই একটি বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। তখন এই বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের অজুহাতের নামে ইসরাইলি বাহিনী ভিড়ের উপর গুলি চালায়। এভাবে শত শত মানুষকে হত্যা করা হয়।

মেনার্ড বলেন, আমি যেখানে কাজ করছিলাম, তার কাছেই ছিল গাজার বিখ্যাত নাসের হাসপাতাল। সেখানে ডাক্তারদের সাথে আমি কথা বলে গুলি চালানোর এই ধরণটির বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা পাই।

তিনি আরো বলেন, আমি ১২ বছর বয়সী একটি ছেলের অস্ত্রোপাচার করেছিলাম। অবশ্য সে পরে বাঁচেনি। তাকে জিএইচএফের এক ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে গুলি করা হয়েছিল। পরে জরুরি কক্ষের একজন সহকর্মীর সাথে আমার এ বিষয়ে কথা হয়। তিনি আমাকে বলেছিলেন যে তিনি ও অন্য চিকিৎসকরা বারবার ‘ক্ষত গোষ্ঠীবদ্ধকরণ’ ও এর শক্তিশালী ধরণ দেখতে পেয়েছেন।

‘ক্ষত গোষ্ঠীকরণ’ বলতে এমন একটি ঘটনাকে বোঝায় যেখানে একাধিক রোগী তাদের শরীরের একই অংশে আঘাত নিয়ে উপস্থিত হন।

পরে তারাই বলেছিলেন যে আসলে ইসরাইলি সেনারা তাদের টার্গেট ঠিক করার কাজে এসব বেসামরিক লোকদের নির্ধারণ করে থাকে। সেজন্য এমন ‘ক্ষত গোষ্ঠীকরণ’ ইস্যু সামনে এসেছে। বিষয়টি তিনি আগে স্কাই নিউজকেও বলেছিলেন।

কোন জবাবদিহিতা বা নিয়ন্ত্রণ নেই

২০২৪ সালের জুলাই মাসে ইসরাইলি ম্যাগাজিন +৯৭২ একটি তদন্ত চালায়। সেখানে তারা গাজা যুদ্ধে অংশ নেয়া বেশ কয়েকজন সৈন্যের সাথে কথা বলেছেন। এ সময় ওই সৈন্যরা জানিয়েছেন যে গাজায় বেসামরিক নাগরিকদের উপর গুলি চালানোর উপর কোনো বিধিনিষেধ নেই।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সৈন্য বলেন, আমাদের হুকুম দেয়া ছিল, কারো থেকে যদি কোনো ধরনের হুমকির আশঙ্কা তৈরি হয়, সাথে সাথে যেন তাদের শরীরে গুলি করা হয়। ফাঁকা গুলি মারা যাবে না। সরাসরি ব্যক্তিকে টার্গেট করতে হবে। এক্ষেত্রে ওই ব্যক্তিটি পুরুষ হোক কিংবা নারী, যুবতী হোক বা বৃদ্ধা। কিছুরই বিচার করার দরকার নেই।

অ্যাকশন অন আর্মড ভায়োলেন্স (এওএভি) ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত উত্থাপিত কিছু অভিযোগের তদন্ত শুরু করেছিল। কিন্তু ওসব অভিযোগের বিরুদ্ধে ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো সমীক্ষাই বন্ধ করে দিয়েছে। শুধুমাত্র একটিতে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কারাদণ্ডের রায় দেয়া হয়েছে।

এওএভি’র মতে, তারা যে ৫২টি মামলা তদন্ত করেছে, তাতে ১,৩০৩ জনকে হত্যা, ১,৮৮০ জনকে আহত করা এবং আরো দু’জনকে নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। এমনকি যখন কোনো ঘটনা ফুটেজ দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে, তখনো ইসরাইলি মন্ত্রিসভার সদস্যসহ জনসাধারণের চাপে অভিযুক্তকে মুক্তি দেয়া হয়েছিল।

ইসরাইলি সেনাবাহিনী নিয়মিত ফিলিস্তিনিদের উপর নির্যাতন করে বলে অভিযোগ ১৯৬৭ সাল থেকে। তখন রেড ক্রিসেন্ট পশ্চিমতীরের নাবলুস কারাগারে বন্দীদের উপর পদ্ধতিগত নির্যাতনের ঘটনা নথিভুক্ত করেছিল। ফিলিস্তিনিদের উল্লেখ করার জন্য ব্যবহৃত অমানবিক ভাষাও বৃদ্ধি পেয়েছে, যা গবেষকরা এখন সেনাবাহিনীর মধ্যে সাধারণ বলে মনে করেন।

১৯৬৭ সালে বার্মায় নিযুক্ত ইসরাইলি রাষ্ট্রদূত ডেভিড হ্যাকোহেনের মতো ইসরাইলি ব্যক্তিত্বরা ফিলিস্তিনিদের মানুষ বলে স্বীকার করতেও রাজি ছিল না। ১৯৮৫ সালে হিব্রু শিশু সাহিত্যের ৫২০টি বইয়ের একটি জরিপে দেখা গেছে, ৮৬টি বইয়ে ফিলিস্তিনিদের ‘অমানবিক, যুদ্ধপ্রেমী, ধূর্ত দানব, রক্তপিপাসু কুকুর, শিকারী নেকড়ে বা সাপ’ হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে।

বিশ বছর আগে ইসরাইলি শিশুদের নমুনা ব্যাচের ১০ শতাংশ ফিলিস্তিনিদের ছবি আঁকতে বলা হলে পশু হিসেবে তাদের চিত্রিত করে। সেই তারাই আজ গাজায় ইসরাইলের হয়ে লড়াই করছে।

আমস্টারডাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাসিয়ানি বলেন, ‘ফিলিস্তিনিদের অমানবিকীকরণ এমন একটি প্রক্রিয়া, যা কয়েক দশক ধরে চলে আসছে। কিন্তু আমি বলবো এটা এখন সম্পূর্ণ।’ তিনি বলেন, ‘আমরা প্রথম দিন থেকে এখন পর্যন্ত অবিশ্বাস্যভাবে নিষ্ঠুর কাজ দেখে আসছি, যেখানে ইসরাইলি সৈন্যরা ৭ অক্টোবরের প্রতিশোধ নিতে চাইছে।’

ইসরাইলি সামরিক বাহিনী সম্পর্কে লিখিত একটি বই ‘অ্যান আর্মি লাইক নো আদার’। এর লেখক হাইম ব্রেশিথ বলেন, এটা যেন পাহাড়ের উপর দিয়ে তুষারগোলক নেমে আসছে যার কোন তল নেই। প্রতি বছর সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বেসামরিক নাগরিকদের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে ব্যবহারের ধারণাটিই এর যৌক্তিক ফলাফল। এটি একটি নতুন খেলা। এটি রক্তাক্ত খেলা। এই খেলাগুলো সর্বদা নীচ থেকে উপরে বিকশিত হয়। এটি বিকৃত, খুনী ও অসুস্থ প্রজন্মের খেলা।

আল জাজিরা অনুবাদ করেছেন আবু সাঈদ