পণ্য গেল, মুদ্রা এলো না : ইরানের অর্থনীতির নীরব রক্তক্ষরণ, দায় কার?

৫০ বিলিয়ন ডলারের রফতানি, ২০ বিলিয়ন ডলার ফেরেনি

ইরানের জন্য এই সঙ্কটের সমাধান শুধু বৈদেশিক মুদ্রার হার সামঞ্জস্যে নয়। বরং রফতানি ও সরবরাহ নীতিতে কঠোর শৃঙ্খলা আনার মধ্যেই নিহিত।

সৈয়দ মূসা রেজা
ইরানের অর্থনীতির নীরব রক্তক্ষরণ হচ্ছে
ইরানের অর্থনীতির নীরব রক্তক্ষরণ হচ্ছে |সংগৃহীত

যে ফুল না ফুটতেই ধরণীর বুকে ঝরে গেছে, যে নদী মরুপ্রান্তরে হারিয়ে ফেলেছে ধারা—কবিতার ভাষায় হয়তো বলা যায়, সে হারা নয়। কিন্তু অর্থনীতির মলিন বাস্তবতা কবিতার এই সান্ত্বনাবাক্য মানে না। নিষেধাজ্ঞার কাঁটাতারে বন্দি ইরানের অর্থনীতি আজ এক অনিবার্য স্রোতে ভেসে যাচ্ছে। রফতানি পণ্যের সব বৈদেশিক মুদ্রা দেশে না ফেরার স্রোতে। এই স্রোতের ঢেউ এসে আঘাত করছে মুদ্রাবাজারে। বাড়াচ্ছে মূল্যস্ফীতি। কমিয়ে দিচ্ছে দেশীয় শিল্পের কাঁচামাল সরবরাহ। আর তার চূড়ান্ত বোঝা গিয়ে পড়ছে সাধারণ মানুষের কাঁধে।

তাসনিম নিউজ-এর অর্থনৈতিক প্রতিবেদকের ভাষায়, নিষেধাজ্ঞার ভেতরে ইরানের নতুনতম সঙ্কটগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো রফতানি থেকে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা শতভাগ দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া কার্যকর না হওয়া।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতে শুধু বৈদেশিক মুদ্রার যোগানই ব্যাহত হচ্ছে না, বরং তৈরি হচ্ছে ‘মুদ্রা-অস্থিরতার এক চক্র।’ মূল্যস্ফীতি রূপ ধারণ করে যা বাড়িয়ে দিচ্ছে প্রতিদিনের জীবনের খরচ।

বৈদেশিক মুদ্রা না ফিরলে রফতানি অনুমতির যুক্তিই বা কী?

প্রশ্ন উঠছে, যদি রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা দেশে ফেরতই না আসে, তবে সেই পণ্যের রফতানি অনুমতি দেয়ারই বা যুক্তি কী? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি কেবল সরকারি রাজস্বের বিষয় নয়; বরং মূল সমস্যা বাজার কাঠামোর এবং বহুমুখী বিনিময় হারের ভাঙন।

তাদের মতে, দেশে একটি মাত্র বিনিময় হার থাকা উচিত। না হলে বাস্তব অর্থনীতির সাথে কোনো সম্পর্ক রাখে না এমন ‘স্বাধীন চোরাচালান’ আর ‘একচেটিয়া’ বাজার মূল্য নির্ধারণে প্রভাব বিস্তার করবে।

বাজারের স্বাভাবিক বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া যখন ভেঙে যায়, তখন যুক্তিসঙ্গত মূল্য নির্ধারণ সম্ভব হয় না। ফলে অর্থনীতির বাস্তব পরিস্থিতি ও বৈজ্ঞানিক মানদণ্ড বিবেচনা করে কৃত্রিমভাবে একটি হার নির্ধারণ করতে সরকার বাধ্য হয়।

নিমা বিনিময় হার- ইরানের সরকারি নিয়ন্ত্রিত পাটাটন

এ প্রেক্ষাপটে ‘নিমা বিনিময় হার’ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এটি ইরানের একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম, যেখানে রফতানিকারকরা তাদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা বিক্রি করেন, আর আমদানিকারকরা তা কিনে প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করেন। খাদ্য, ওষুধ, ও শিল্প কাঁচামাল তুলনামূলক সস্তায় যেন আমদানি করা যায়, সেজন্য সরকার এই হারের মাত্রা নির্ধারণ করে। এই হার সাধারণত মুক্ত বাজার হারের চেয়ে কম হয়। তবে যখন নিমা হার ও মুক্ত বাজার হারের পার্থক্য বেশি থাকে, রফতানিকারকদের জন্য সরকারি হারে মুদ্রা ফেরানো অলাভজনক হয়ে পড়ে। ফলস্বরূপ অনেক মুদ্রা দেশে ফেরে না।

৫০ বিলিয়ন ডলারের রফতানি, ২০ বিলিয়ন ডলার ফেরেনি

গত বছরের বৈদেশিক মুদ্রা নীতি দেখিয়েছে, এই পথে বড় চ্যালেঞ্জ আছে। উদাহরণস্বরূপ, মুক্ত বাজারের সাথে পার্থক্য কমে এবং রফতানিকারকরা মুদ্রা দেশে ফেরাতে উৎসাহিত হন, সেজন্য ২০২৩ সালে নিমা বিনিময় হার প্রায় ৪০ হাজার তুমান থেকে বাড়িয়ে ৬৮ হাজার ৯০০ তুমান করা হয়। কিছু রফতানিকারক এমনকি প্রায় ৬০ হাজার তুমান হারে মুদ্রা ফেরানোর প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু বাস্তবে, এই হার মুক্ত বাজারের কাছাকাছি নিয়ে এলেও ৫০ বিলিয়ন ডলারের অ-তেল পণ্য রফতানির মধ্যে ২০ বিলিয়ন ডলার দেশের অর্থনীতিতে ফেরেনি।

অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ রেজা গুলামি সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে সরকারি পরিসংখ্যানের বরাতে বলেন, ‘৫০ বিলিয়ন ডলার রফতানির মধ্যে ২০ বিলিয়ন ডলার ফেরেনি। আপনি তো বলেন, গুঁড়া দুধ আমদানির জন্য বৈদেশিক মুদ্রা নেই। তাহলে এই অর্থ ফেরাতে কী ব্যবস্থা নিয়েছেন? বৈদেশিক মুদ্রা ফেরানো যাবে না এমন হলে কেন সেই পণ্য রফতানির অনুমতি দিলেন? এতে তো রফতানিকারক জনগণের টেবিল থেকে পণ্যও নিয়ে গেল, আবার গুঁড়া দুধ আনা যেত সে বৈদেশিক মুদ্রাও ফেরান গেল না।’

এই অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞের মতে, ‘এতে আপনি দেশের ওপর দুই ধরনের বোঝা চাপাচ্ছেন। তাই বলি, যদি শসা রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা ফেরানো না যায়, তবে সেটি এখানেই থাকুক, মানুষ অন্তত খাক। এতে একটি বোঝা থাকবে, দু’টি নয়।’

ডিটারজেন্ট শিল্পে কাঁচামালের সঙ্কট, পেট্রোকেমিক্যাল রফতানি অগ্রাধিকার

বৈদেশিক মুদ্রা ফেরত আনা ও রফতানির অগ্রাধিকার নির্ধারণের এই সমস্যা অনেক সময় সরাসরি জনগণের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ নিরাপত্তার সাথে যুক্ত। এর জ্বলন্ত উদাহরণ ডিটারজেন্ট শিল্প। বর্তমানে এই খাতের উৎপাদন সক্ষমতার অর্ধেক অবস্থায় ক্ষমতায় চলছে। কারণ গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল, যা দেশীয় পেট্রোকেমিক্যাল শিল্প থেকেই আসা উচিত তার বড় অংশ রফতানি হয়ে যাচ্ছে। বিস্ময়ের বিষয়, এই রফতানি উচ্চ মূল্যে হচ্ছে না। বরং হচ্ছে দেশীয় বাজারের দামের চেয়েও কমে।

সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, এ বছরের প্রথম প্রান্তিকে কিছু পেট্রোকেমিক্যাল কোম্পানি দেশীয় উৎপাদনকারীদের জন্য নির্ধারিত সর্বনিম্ন কোটাও পূরণ করেনি। উদাহরণস্বরূপ, একটি কৌশলগত কাঁচামালের মাত্র ৫৫ শতাংশ কোটাই শেয়ারবাজারে সরবরাহ করা হয়েছে। অথচ দেশের উৎপাদন ক্ষমতার অর্ধেক অপূর্ণ থেকে যাচ্ছে, তবু রফতানি অব্যাহত। জানা দরকার, এই কোটাগুলোও প্রকৃত চাহিদার মাত্র ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ মেটায়। যখন এই ন্যূনতম কোটাও পূরণ হয় না, তখন গোটা উৎপাদন শৃঙ্খলই চাপে পড়ে যায়।

সরবরাহই মূল সঙ্কট, দাম নয়

দেশীয় উৎপাদকরা এখন এমন এক সঙ্কটে পড়েছে, যেখানে দামই মূল সমস্যা নয়- বরং সরবরাহ। উৎপাদকরা বেশি দামে কিনতেও রাজি। কিন্তু বাজারে পণ্যই নেই। এর ফলে, দেশীয় বাজারের চাহিদা তীব্র থাকার পর ভারসাম্য ভেঙে পড়ছে এবং কাঁচামাল রফতানির দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে।

শেষমেষ, প্রশ্নটা আবারো সেখানেই গিয়ে ঠেকে, যদি রফতানির অর্থ দেশে ফেরত না আসে, তবে সেই রফতানি কার স্বার্থে? এটি কি ইরানের জনগণের জন্য কোনো লাভ আনে, নাকি কেবল অর্থনীতির নীরব রক্তক্ষরণ বাড়ায়? ইরানের জন্য এই সঙ্কটের সমাধান শুধু বৈদেশিক মুদ্রার হার সামঞ্জস্যে নয়। বরং রফতানি ও সরবরাহ নীতিতে কঠোর শৃঙ্খলা আনার মধ্যেই নিহিত।