হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকরের পরও গাজায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে গণহত্যা অব্যাহত রয়েছে বলে জাতিসঙ্ঘ জানিয়েছে।
জাতিসঙ্ঘের ফিলিস্তিনবিষয়ক বিশেষ দূত ফ্রান্সেসকা আলবানিজ তার সর্বশেষ প্রতিবেদনে গাজার মানবিক পরিস্থিতিকে ‘স্পষ্ট গণহত্যা’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, ইসরাইল যুদ্ধবিরতির চুক্তিগুলো লঙ্ঘন করে এখনো ফিলিস্তিনিদের হত্যা, বাস্তুচ্যুত করা ও অনাহারে রাখার নীতি চালিয়ে যাচ্ছে।
এই প্রতিবেদনে শুধু সামরিক হামলার দিক নয়। বরং যৌন সহিংসতা, চিকিৎসাকেন্দ্র ধ্বংস এবং হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে বন্দি রাখার বিষয়গুলোও তুলে ধরা হয়েছে।
আলবানিজ উল্লেখ করেছেন, যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পরও ২০০-র বেশি ফিলিস্তিনি শহীদ হয়েছেন, যা ইসরাইলের আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলোর প্রতি সম্পূর্ণ অবহেলার প্রমাণ। তিনি আরো বলেন, ইসরাইলকে অস্ত্র ও রাজনৈতিক সহায়তা প্রদানকারী দেশগুলোও এই গণহত্যায় সহযোগী এবং তাদেরও দায় বহন করতে হবে।
প্রতিবেদনের আরেক অংশে স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও হাসপাতালগুলোর ইচ্ছাকৃত ধ্বংসের কথাও বলা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ‘আল-বাসমা’ হাসপাতালের প্রসূতি বিভাগে সরাসরি হামলায় হাজার হাজার ফিলিস্তিনি ভ্রূণ ধ্বংস হয়েছে; আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এটি ফিলিস্তিনিদের প্রজন্ম বিলুপ্ত করার উদ্দেশ্যমূলক প্রচেষ্টা।
এই অপরাধগুলোর পাশাপাশি, ১০ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি এখনো ইসরাইলি কারাগারে আটক আছেন। অথচ ইসরাইলি বন্দিরা ইতোমধ্যে মুক্তি পেয়েছেন। বন্দিদের প্রতি এই বৈষম্যমূলক আচরণকে জাতিসঙ্ঘ ‘বর্ণবৈষম্যমূলক ব্যবস্থা’র অংশ হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং তা বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে। আলবানিজ আরো বলেন, ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের ভয় দেখানো ও নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে যৌন সহিংসতা ব্যবহার করছে।
এদিকে, জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস আবারো যুদ্ধবিরতি রক্ষা ও দখলদারিত্বের অবসান ঘটিয়ে ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি গাজার যুদ্ধবিরতি বারবার লঙ্ঘনের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন অব্যাহত থাকাকে গভীরভাবে উদ্বেগের সাথে দেখছি।’ গুতেরেস গাজার ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞের কথা উল্লেখ করে শিক্ষা ব্যবস্থা পুনর্গঠন ও জরুরি সেবাগুলোর পুনরুদ্ধারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
গাজা উপত্যকায় ইহুদিবাদী সেনাবাহিনী কর্তৃক ফিলিস্তিনিদের গণহত্যা অব্যাহত রাখা সম্পর্কে জাতিসঙ্ঘের কঠোর সতর্কতা, এই দুর্যোগপীড়িত অঞ্চলে আক্রমণ অব্যাহত রাখার পাশাপাশি, এই অবৈধ রাষ্ট্রের অপরাধী চরিত্রকে নির্দেশ করে, যা যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পরেও নির্যাতিত গাজাবাসী হত্যা করে চলেছে।
তবে এসব সতর্কবার্তার পরও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া দুর্বল ও অপ্রতুল রয়ে গেছে। স্পষ্টতই যুক্তরাষ্ট্রের ‘সবুজ সঙ্কেত’ ছাড়া গাজায় ইসরাইলের এসব অপরাধ সম্ভব নয়। আশ্চর্যের বিষয় হলো, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার সাম্প্রতিক এক বক্তব্যে এই বিষয়টি স্বীকারও করেছেন। তিনি বলেছেন, গাজায় ইসরাইলের সাম্প্রতিক হামলাগুলো কোনোভাবেই যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন নয়। বরং ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে। ট্রাম্প দাবি করেছেন, ‘গাজার যুদ্ধবিরতির কোনো কিছুই বিপন্ন হয়নি।’
এখানে প্রশ্ন আসে, ট্রাম্পের দৃষ্টিতে আসলে ইসরাইলের কোন পদক্ষেপ যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন হিসেবে গণ্য হবে? নিঃসন্দেহে মার্কিন প্রেসিডেন্টের দৃষ্টিতে, যদি হামাস নিজেকে রক্ষা করার অথবা ইসরাইলের বর্বর হামলার জবাব দেয়ার জন্য সামান্যতম কোনো কাজও করে, তাহলে সেই কাজটি যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন হিসেবে গণ্য হবে। এই অবস্থানটি প্রমাণ করে যে ইসরাইলের উপর হামলা বন্ধ করার জন্য চাপ দেয়ার কোনো ইচ্ছা ট্রাম্পের নেই। কারণ তিনি এই রাষ্ট্রের কর্মকাণ্ডকে নিরাপত্তা হুমকির প্রতি বৈধ প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখেন।
অন্যদিকে, প্রাথমিক যুদ্ধবিরতি আলোচনার সময় ট্রাম্প ইসরাইলের প্রতি চুক্তি মেনে চলার নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন বলে জানা গেছে; কিন্তু যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের পর তিনি কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেননি। এই অবস্থান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহ্যগত ইসরাইল-সমর্থন নীতিরই ধারাবাহিকতা এবং প্রমাণ করে যে ট্রাম্প প্রশাসন নিরপেক্ষতার চেয়ে ইসরাইলের কৌশলগত স্বার্থকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে। ফলে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের পরও ট্রাম্পের নিষ্ক্রিয়তা দুর্বলতা নয়, বরং রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাগত মিত্রতার প্রকাশ।
সূত্র : পার্সটুডে



