এক সময় ছিল, যখন ত্রিমাত্রিক জৈবছাপানো অর্থাৎ থ্রিডি বায়োপ্রিন্টিং—প্রযুক্তি ও হাড় শোষণকারী জৈব ইমপ্লান্ট ছিল কেবল গুটিকয়েক উন্নত দেশের একচেটিয়া দখলে। অথচ এখন সেই চূড়ায় স্থান করে নিয়েছে ইরান। দেশটির বিজ্ঞানীরা নিজস্ব জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে তৈরি করে ফেলেছেন এমন প্রযুক্তি।
ইরানের তাসনিম বার্তা সংস্থা আরো বলেছে, ইরানে তৈরি এই প্রযুক্তি শুধু জৈব উপাদান ছাপতেই পারে না। বরং এ পদ্ধতিতে রোগীর চোয়াল কিংবা খুলি পর্যন্ত মেরামত করা যায়। আর এই প্রযুক্তির জন্য ইরান এখন বিশ্বের সেরা তিন দেশের তালিকায়!
জৈবছাপানে মানে?
প্রথমে একটুখানি বুঝে নেয়া যাক, এই ত্রিমাত্রিক জৈবছাপানো বা থ্রিডি বায়োপ্রিন্টিং জিনিসটা কী? এটা এমন এক যন্ত্র, যা কালি কিংবা রঙ নয়, ছাপে জীবন্ত কোষ বা জৈব উপাদান! এর সাহায্যে তৈরি করা যায় ত্বক, তরুণাস্থি এমনকি কৃত্রিম হাড়ের খাঁচা বা ‘স্ক্যাফোল্ড’। এই খাঁচার মধ্যে শরীরের কোষগুলো প্রবেশ করে, বসতি গড়ে এবং সময়ের সাথে সাথে ধাপে ধাপে তৈরি করে প্রকৃত হাড় বা টিস্যু। আর এই স্ক্যাফোল্ডটা এমন উপাদানে তৈরি, যা শরীর চিনতে পারে, সহজে গ্রহণ করে এবং আস্তে আস্তে শোষণ করে নেয়।
শুরুটা হয়েছিল তেহরানের শরীফ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে
২০১৬ সালের কথা। তেহরানে অবস্থিত ইরানের খ্যাতনামা শরীফ প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রোথ সেন্টারে মেকানিকস ও কেমিস্ট্রির ছাত্র তিন তরুণ ভাবলেন এমন এক থ্রিডি প্রিন্টার বানাবেন যা ছাপাবে জীবন্ত কোষ। প্রাথমিক নকশা নিয়েই তারা পৌঁছে গিয়েছিলেন শাহিদ বেহেশতি বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু অগ্রিম অর্থ না পেয়ে তারা নিজ উদ্যোগেই যাত্রা শুরু করেন। নিজেদের অর্থ খরচ করে তৈরি করেন প্রথম পরীক্ষামূলক বা প্রোটোটাইপ যন্ত্র। এই যন্ত্রের দাম তখন আমেরিকায় ছিল প্রায় দুই লাখ ডলার। আর গোটা বিশ্বে তখন মাত্র পাঁচ-ছয়টি কোম্পানি এ নিয়ে কাজ করছিল। তাই যখন তারা বললেন—‘আমরাও বানিয়েছি’—তখন অনেকেই বিশ্বাস করতে চাননি ইরানি এই তিন ছাত্রের দাবি। এমনকি হার্ভার্ড আর এমআইটিতে কাজ করা কিছু গবেষকও বলেন, ‘এমন কাজ ইরানে সম্ভবই নয়!’
‘অসম্ভব’ থেকে ‘সম্ভব’-এর পথে
২০১৮ সাল নাগাদ তারা যন্ত্রটি ব্যবহার করে সেবা দেয়া শুরু করেন। প্রথম একজন ছাত্র, যিনি নেদারল্যান্ডসে এ প্রযুক্তির সাথে পরিচিত হয়েছিলেন, ব্যবহার করেন এই প্রিন্টার। তারপর আস্তে আস্তে তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে প্রদর্শনীতে যন্ত্র উপস্থাপন করেন তারা।
তখনই দেখা হয় তেহরান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণ অধ্যাপকের সাথে। যিনি হার্ভার্ডে গবেষণার সুযোগে ড. খাদেম আল-হোসেইনির সাথে কাজ করেছিলেন। খাদেম হলেন বায়োপ্রিন্টিংয়ে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় গবেষকদের অন্যতম। তিনি যন্ত্রটি কিনতে চাইলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট স্বল্পতার কারণে পারছিলেন না। অবশেষে ২০১৮ সালের মার্চে তিনি কিছু অর্থ জমা দেন এবং ২০১৯ সালের এপ্রিল নাগাদ তারা তৈরি করেন প্রথম কাস্টমাইজড যন্ত্র। এই যন্ত্রটি প্রমাণ করে দেয়, ইরানেও সম্ভব বায়োপ্রিন্টার তৈরি করা, চালানো এবং উন্নয়ন করা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে
২০১৯-২০ সাল নাগাদ তারা দেশে অন্তত ৫০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে যন্ত্র বিক্রি করে ফেলেন। তবে তখনই বুঝে ফেলেন শুধু বিশ্ববিদ্যালয় বাজার দিয়ে হবে না। তাই তাঁরা আন্তর্জাতিক সহযোগিতা খুঁজতে থাকেন। এ সময়ই এক প্রবাসী ইরানি গবেষকের সাথে দেখা হয়, যিনি সিগমা-র মতো বড় বড় আন্তর্জাতিক রাসায়নিক কোম্পানির সাথে কাজ করতেন। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তিন ধরনের জৈব উপাদান বা বায়োমেটেরিয়ালের পেটেন্টও করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘তোমরা যদি আমার উপাদান দিয়ে ছাপাতে পারো, তাহলে আমি প্রযুক্তি হস্তান্তরে রাজি।’ ছাপানোর ভিডিও দেখে তিনি এতটাই মুগ্ধ হন যে উপাদান পাঠিয়ে দেন এবং সফলভাবে প্রিন্ট করে তারা প্রযুক্তি হস্তান্তরের কাজ সম্পন্ন করেন।
এই তিন উপাদান দিয়ে তৈরি স্ক্যাফোল্ড এখন ত্বক ও তরুণাস্থি গবেষণায় ব্যবহার হচ্ছে। তবে এখনও তা রোগীর দেহে প্রতিস্থাপনযোগ্য নয়। কিন্তু বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের পথ তৈরি হচ্ছে।
হাড় গঠনকারী স্ক্যাফোল্ড : ধাতব নয়, জীবন্ত হাড়ের মতো
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো এই স্ক্যাফোল্ড ধাতব নয়, বরং দেহে শোষণযোগ্য খনিজ পদার্থে তৈরি। সাধারণত দুর্ঘটনায় চোয়াল বা মুখের হাড় ভেঙে গেলে, আগে টাইটেনিয়াম ইমপ্লান্ট বসানো হতো। কিন্তু সেটি আবার অপসারণ করতে হতো, ছিল ব্যথা আর বিপদের ঝুঁকি। কিন্তু এই নতুন জৈবছাপানো স্ক্যাফোল্ড শুধু একবার বসালেই হয়। ধীরে ধীরে সেটি গলে গিয়ে আসল হাড় হয়ে যায়। রোগীর শরীরে ওই খাঁচা সরানোর জন্য দ্বিতীয় অপারেশনের প্রয়োজন পড়ে না।
মাথার খুলিতেও আগে ধাতব টুকরো বসানো হতো। কিন্তু এমআরআই বা সিটি স্ক্যানে সমস্যায় পড়তেন রোগীরা। কখনো টাইটেনিয়ামের কারণে স্নায়ুতে সমস্যা, বেশি তাপমাত্রায় খিচুনি হতো। নতুন প্রযুক্তির বায়োস্ক্যাফোল্ডে এসব ঝুঁকিই নেই।
সাফল্যের গল্প : চোখের নিচে ভেঙে যাওয়া হাড়ের পুনর্গঠন
তারা জানান এক রোগীর কথা। এক নারী, যার চোখের নিচের হাড় দুর্ঘটনায় ভেঙে গিয়েছিল। চোখ একদিকে ঝুলে গিয়েছিল, আর ছিল ডাবল ভিশন। তাদের তৈরি স্ক্যাফোল্ড বসিয়ে হাড় পুনর্গঠন করা হয় এবং চোখ আগের অবস্থানে ফিরে আসে। এই অপারেশন সিনা হাসপাতাল, তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্পন্ন হয়। আরেক রোগীর চোখের কোটর নষ্ট হয়ে গিয়েছিল এবং আগের বসানো টাইটেনিয়াম অপটিক নার্ভে আঘাত করছিল। নতুন স্ক্যাফোল্ডে সে বিপদ দূর হয়।
সরকারি স্বীকৃতি ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
২০২১ সালের শুরুতে তারা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জেনারেল ডিরেক্টরেট অব মেডিক্যাল ইকুইপমেন্ট-এর সাথে পরামর্শ শুরু করে। অবশেষে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে তারা চোয়াল, মুখ ও খুলির হাড়ের চিকিৎসার জন্য সরকারি লাইসেন্স পেয়ে যান।
এই জৈব হাড় স্ক্যাফোল্ড রোগীর দেহে বসিয়ে দিলে ১৮ থেকে ২৪ মাসের মধ্যে তা দেহের নিজস্ব হাড়ে রূপান্তরিত হয়। এই স্ক্যাফোল্ডে ব্যবহার করা পদার্থ, বায়োপলিমার, বায়োহাইড্রোজেল ও বায়োসিরামিকস। এ তিন উপদানের সবই মানবদেহের জন্য নিরাপদ ও গ্রহণযোগ্য।
বর্তমানে ইরান বিশ্বের তিনটি দেশের একটি, যারা হাড় শোষণযোগ্য ইমপ্লান্ট তৈরিতে সক্ষম। এর পুরো গবেষণা ও উন্নয়ন কাজ হয়েছে ইরানের অমিদ আফারিনান নামের এক জ্ঞানভিত্তিক কোম্পানিতে ড. মাজিদ হাজি হোসেইন আলির নেতৃত্বে। এই প্রকল্পে সহায়তা করেছে ন্যানো প্রযুক্তি উন্নয়ন সদর দফতর এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ডেপুট-প্রেসিডেন্সি।
শেষ কথা
এই প্রযুক্তি শুধু চিকিৎসাকে সহজ করেনি। বরং হয়ে উঠেছে ব্যয়বহুল ধাতব ইমপ্লান্টের বিকল্প। রোগী পাচ্ছে কম যন্ত্রণা, ডাক্তার পাচ্ছেন নতুন সম্ভাবনা। ভবিষ্যতে ডায়াবেটিস রোগীর ত্বক পুনর্গঠন, নাসারন্ধ্রের হাড়, কানের লতি, এমনকি যকৃৎ কোষ ছাপানোর পথও খুলে দিচ্ছে এই প্রযুক্তি।
এক সময় যারা বলেছিল, ‘ইরানে এই কাজ অসম্ভব’, তাদের ভুল প্রমাণ করে তরুণ ইরানিরা আজ থ্রিডি জৈব ছাপানোর বিশ্ব মঞ্চে ইরানের বিজয় পতাকা উড়িয়েছে।