হোয়াইট হাউজ ২০টি ধারা সম্বলিত একটি চুক্তি পেশ করেছে। তারা এটিকে ‘শান্তি চুক্তি’ হিসেবে অভিহিত করেছে। ওই চুক্তিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু স্বাক্ষর করেছেন। চুক্তিটিকে গাজা যুদ্ধের নতুন দিগন্ত হিসেবেও প্রচার করা হচ্ছে। কারণ, তাতে যুদ্ধ বন্ধ ও গাজার পুনর্গঠনের মতো মানবিক বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
কিন্তু ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন যখন তাদের শতাব্দির দীর্ঘ অভিজ্ঞতা নিয়ে ওই পরিকল্পনায় নজর বুলালো, দেখতে পেল যে এতে বড় ধরনের শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে- ফিলিস্তিনিদেরকে কেবল ছাড়ই দিতে বলা হয়েছে। অপর পক্ষকে দেয়া হয়েছে সুবিধামতো সর্বোচ্চ সুবিধা। যেমনটি দেখা গেছে, বেলফোর ডিক্লারেশন (১৯১৭), টু-স্টেট সলিউশন (১৯৪৭) ও অসলো চুক্তি (১৯৯৩) ইত্যাদি।
এখন স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে যে তবে নতুন এই প্রস্তাবনায় কী আছে? আসলে এই পরিকল্পনাটিকে বাহ্যিকভাবে অনেক মানবিক ও ভালো প্রস্তাবনা হিসেবে মনে হতে পারে। মনে হতে পারে এর মধ্য দিয়ে সঙ্ঘাত বন্ধ হবে এবং শাস্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হবে। কিন্তু এর কিছু ধারাতে এমন ফাঁক-ফোকর রয়েছে, যাতে বড় ধরনের রাজনৈতিক ঝুঁকির আশঙ্কা রয়েছে।
প্রথমত : এখানে গাজায় রক্তপাত বন্ধ করার জন্য তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এতটুকু ভালো। কিন্তু একে এমন কিছু শর্তের সাথে সম্পৃক্ত করা হয়েছে, যাতে বুঝা যায় যে এটি চূড়ান্ত কোনো চুক্তি নয়। বরং এর মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনিদের শক্তি পরীক্ষা করা হচ্ছে যে তারা নতুন শর্তাবলী আরোপ করা হলে মানবে কিনা?
দ্বিতীয়ত : প্রস্তাবনায় হামাসকে পূর্ণরূপে অস্ত্র সমর্পণের কথা বলা হয়েছে। এদিকে, ইসরাইলকে সম্পূর্ণরূপে অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত থাকার সুযোগ দেয়া হয়েছে। যাতে বুঝা যায় যে এই চুক্তিতে সমতা নেই। বরং হামাসকে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দেয়া হচ্ছে।
তৃতীয়ত : প্রস্তাবনায় বন্দীবিনিময়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে এতেও সমতা বিধান করা হয়নি। একদিকে হামাসকে ইসরাইলি বন্দীদের মুক্তি দেয়ার শর্ত করা হয়েছে। অন্যদিকে ইসরাইল ফিলিস্তিনের এমন কিছু বন্দীকে মুক্তি দেবে, যাদেরকে কোনো কারণ ছাড়াই আটক করা হয়েছে; হামাসের কোনো রাজবন্দীদের মুক্তি দেবে না।
চতুর্থত : ইসরাইলি বাহিনীর প্রত্যাহারকে শর্তযুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ ফিলিস্তিনিরা যদি প্রস্তাবনার সকল চুক্তি মান্য করে, তাহলে ইসরাইল বাহিনী প্রত্যাহার করবে। কিন্তু তারা যদি কোনো চুক্তি লঙ্ঘন করে, তাহলে ইসরাইল তাদের বাহিনী প্রত্যাহার করবে না। অর্থাৎ ইসরাইলি বাহিনীর প্রত্যাহারকে ফিলিস্তিনিদেরকে চাপে রাখার কৌশল হিসেবে রাখা হয়েছে।
পঞ্চমত : এই পরিকল্পনার সবচেয়ে বিপজ্জনক ও ভয়ঙ্কর ধারাটি হলো গাজা পরিচালনার জন্য আন্তর্জাতিক পক্ষকে টেনে আনা। বিশেষ করে অন্তর্বর্তী সরকারকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন রাখা এবং তাতে ইরাকের কসাই টনি ব্লেয়ারের মতো ব্যক্তিদের রাখা। তদুপরি অন্তর্বর্তী সরকার কতদিন দায়িত্বে থাকবে, তারও কোনো সময়সীমা উল্লেখ না করা। অতীত অভিজ্ঞতা বলে, এই জাতীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার স্থায়ীভাবেই বসে পড়ে। তখন গাজাকে পশ্চিমতীরের চেয়ে আলাদা করার এবং ফিলিস্তিনিদের জাতীয় স্বার্থ ব্যর্থ করার দরজা খুলে যাবে।
ষষ্ঠত : গাজার পুনর্নির্মাণকে বড় ধরনের পুরস্কার হিসেবে পেশ করা হয়েছে। তবে এটিও শর্তযুক্ত। তহবিল ও প্রকল্প বাইরে থাকবে। শর্ত মানা হবে তো পুনর্নির্মাণ কার্যক্রম চলবে। শর্ত মানা হবে না তো সব বন্ধ থাকবে।
সর্বশেষ : শেষ ধারায় ট্রাম্প সরাসরি হুমকি দিয়েছেন যে এই প্রস্তাবনা কেবল শান্তিচুক্তির প্রস্তাবনাই নয়। বরং এটি যদি গ্রহণ করা হয়, তাহলে যাবতীয় সহায়তার দ্বার উন্মোচিত হবে। আর যদি গ্রহণ করা না হয়, তাহলে ইসরাইলি আগ্রাসন অব্যাহত রাখার জন্য আমেরিকা সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে।
এসব দিক গভীরভাবে লক্ষ্য করলে বুঝা যায় যে এটি যুদ্ধবিরতি কিংবা গাজার পুনর্নির্মাণের কোনো চুক্তি নয়। বরং এটি একটি রাজনৈতিক চাল, যাকে শান্তিচুক্তির মোড়কে উপস্থাপন করা হয়েছে। এবং এর মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনিদের জাতীয় স্বার্থকে গভীরভাবে ব্যর্থ করার ফন্দি আঁটা হয়েছে। সেজন্য এটি কোনো মানবিক বা রাজনৈতিক চুক্তি নয়। বরং দখলদারিত্বকে নতুনমাত্রায় চাপানোর জন্য অভিনব কৌশল।
সূত্র : আল জাজিরা