যুদ্ধের আগুনে বাজি

ইরানে সামরিক হামলা চালিয়ে ট্রাম্পের অজানা জুয়া

এই সিদ্ধান্ত ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের সবচেয়ে বড় এবং সম্ভবত সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ। তিনি বিশ্বাস করেন, ইরান যেভাবেই পাল্টা জবাব দিক না কেন, যুক্তরাষ্ট্র তা প্রতিহত করতে পারবে।

সৈয়দ মূসা রেজা

নিউ ইয়র্ক টাইমসের হোয়াইট হাউজ এবং মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত প্রতিবেদক ডেভিড স্যাঙ্গার। গত চার দশকের বেশি সময় ধরে দৈনিকটির সাংবাদিক হিসেবে কাজ করছেন। মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি ও জাতীয় নিরাপত্তার সমস্যা বিষয়ক চারটি বইয়ের লেখক গত প্রায় ২০ বছর ধরে ইরানের পামাণবিক তৎপতা বন্ধ করা বিষয়ক মার্কিন তৎপরতার বিষয় খবরাখবর করছেন। আজকে নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে শুরুতে তিনি লিখেছেন, রোববার ভোররাত, ইরানের স্থানীয় সময় আনুমানিক ২টা ৩০ মিনিট। বিশ্ব ঘুমিয়ে থাকলেও হোয়াইট হাউসে জেগে ছিল যুদ্ধ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এমন একটি সামরিক হামলার নির্দেশ দিলেন, যা তার আগের চার প্রেসিডেন্টও ইচ্ছা করেও এড়িয়ে গিয়েছিলেন। তাদের ভয় ছিল—এই হামলা যুক্তরাষ্ট্রকে মধ্যপ্রাচ্যের এক অপ্রতিরোধ্য যুদ্ধে ঠেলে দিতে পারে।

ট্রাম্পের নির্দেশে বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত বি-টু বোমারু বিমানগুলো উড়ে গেল অর্ধ-দুনিয়া পার হয়ে। তাদের লক্ষ্য—ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলোর সবচেয়ে গোপন আর গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো। মূল নিশানা ছিল পাহাড়ের নিচে লুকিয়ে থাকা ‘ফোরদো’ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র। ইসরাইল যেখানে পৌঁছাতে পারেনি, সেখানে আঘাত হানল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

এই সিদ্ধান্ত ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের সবচেয়ে বড় এবং সম্ভবত সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ। তিনি বিশ্বাস করেন, ইরান যেভাবেই পাল্টা জবাব দিক না কেন, যুক্তরাষ্ট্র তা প্রতিহত করতে পারবে। যদিও ইরানের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে থাকা ৪০ হাজারের বেশি মার্কিন সেনা। ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রের সরাসরি আওতায় রয়েছে এরা সবাই।

ট্রাম্পের জুয়া এখানেই থেমে নেই। তিনি ধরে নিচ্ছেন, ইরান দুর্বল হয়ে এতটাই পিছু হটবে যে, তাদের পরিচিত পন্থা (কথিত) সন্ত্রাস, পণবন্দি করা, কিংবা সাইবার হামলার মতো পদ্ধতি দিয়ে প্রতিশোধ নিতে পারবে না। সবচেয়ে বড় বাজি হলো, ইরানের পরমাণু কর্মসূচি আর কোনো দিন ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না, ট্রাম্পের বিশ্বাস।

কিন্তু এ বিশ্বাস কতটা যুক্তিসংগত? ইরান বহুবার বলেছে, যদি তেহরানে হামলা হয়, ইরান পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাবে। পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পূর্ণ গোপনে চালিয়ে যাবে।

ফোরদো যে এত গুরুত্ব পাচ্ছে, তার কারণও রয়েছে। ২০০০ সালের মাঝামাঝি গোপনে গড়ে ওঠা এই পরমাণু স্থাপনাটি ২০০৯ সালে প্রথম প্রকাশ্যে আনেন বারাক ওবামা। এখানেই তৈরি হচ্ছিল প্রায়-বোমা-বানানোর উপযোগী ইউরেনিয়াম। এতে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগে পড়েছিল আমেরিকা ও তার মিত্ররা।

হোয়াইট হাউসের দাবি, ইরানে এই আগাম অভিযান কেবলমাত্র পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংসের জন্য, ইরানকে বা ইরানের শাসকদের ধ্বংস করার জন্য নয়। ট্রাম্প প্রশাসনের ভাষায়, এটি সীমিত, ‘নির্ভুল’ অভিযান—ঠিক যেমন ২০১১ সালে ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করা হয়েছিল।

কিন্তু এই তুলনায় অস্বস্তি বোধ করছেন ইউরোপীয় কূটনীতিকরা। একজন জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক বলেই বসেন, “বিন লাদেন ৩ হাজার মার্কিনিকে হত্যা করেছিল। ইরান তো এখনও বোমাই বানায়নি।”

ট্রাম্পে দাবি, ইরানে এই হামলা যুদ্ধের ঘোষণা নয়। কিন্তু তার সুর ছিল কঠোর। ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স, পররাষ্ট্র সচিব মার্কো রুবিও এবং প্রতিরক্ষা সচিব পিট হেগসেথকে পাশে নিয়ে হোয়াইট হাউস থেকে দেওয়া বক্তৃতায় তিনি বলেন, “মধ্যপ্রাচ্যের মাতব্বরি করা ইরানকে এখন শান্তির পথে আসতে হবে। যদি না আসে, ভবিষ্যতের হামলা হবে আরও ভয়ংকর এবং আরও সহজ।”

তিনি আরো বলেন, “শান্তি হবে, নাকি ইরানের জন্য এক ভয়াবহ ট্র্যাজেডি—তা এখন তেহরানের হাতে। মনে রাখুন, এখনও অনেক টার্গেট বাকি।”

এই বক্তব্য দিয়ে ট্রাম্প আসলে পরিষ্কার করে দিলেন, যুক্তরাষ্ট্র এখন ইসরাইলের পাশে পুরোপুরি নেমে পড়েছে। যদিও প্রথমদিকে মার্কো রুবিও বলেছিলেন, ইসরাইলের আক্রমণ একক সিদ্ধান্ত, যুক্তরাষ্ট্র জড়িত নয়। কিন্তু এরপর ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বলেন—“আমেরিকা চাইলেই ইরানের ৮৬ বছর বয়সী সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনেয়ীকে হত্যা করতে পারে।”

ইসরাইলের পাল্টা হামলার পর, যেটা শুরু হয়েছিল ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার জবাবে, ইরান একেবারে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছে। হামাস এবং হিজবুল্লাহ প্রায় ধ্বংস, আসাদ পালিয়েছে, আর চীন-রাশিয়া নীরব।

পারমাণবিক কর্মসূচিই ছিল ইরানের শেষ আত্মরক্ষার অস্ত্র। এ কেবল বিজ্ঞান বা প্রযুক্তি নয়, বরং ইরানের আত্মমর্যাদার প্রতীক। ১৯৭৯ সালে যেভাবে আমেরিকান দূতাবাস থেকে ৫২ জনকে পণবন্দি করে ইরান নিজেদের অবস্থান জানিয়ে দিয়েছিল, ঠিক তেমনি গত দুই দশকে পারমাণবিক কর্মসূচি হয়ে উঠেছিল ইরানের অপ্রতিরোধ্য প্রতিরোধের প্রতীক।

ভবিষ্যতের ইতিহাসবিদরা হয়তো একদিন লিখবেন—১৯৭৯ সালের চোখ বাঁধা আমেরিকান পণবন্দি আর আজকের ফোরদোর উপর ফেলা জিবিইউ-৫৭ বাঙ্কার-ধ্বংসকারী বোমার মধ্যে এক সরল রেখা রয়েছে। তারা হয়তো জিজ্ঞেস করবেন, কেউ কি এই সংঘাতের পথ এড়াতে পারত না?

কংগ্রেসে ইতিমধ্যেই সমালোচনা শুরু হয়েছে। গোয়েন্দা কমিটির শীর্ষ ডেমোক্র্যাট মার্ক ওয়ার্নার বলেন, “ট্রাম্প এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কংগ্রেসকে না জানিয়েই, কোনো সুস্পষ্ট কৌশল ছাড়াই, এবং গোয়েন্দা প্রতিবেদনের সুসংগত বার্তা উপেক্ষা করে—যেখানে বলা হয়েছিল, ইরান এখনই বোমা তৈরি করার পথে এগোয়নি।”

তবুও, যদি ইরান প্রতিশোধ নিতে না পারে, যদি আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী তার ক্ষমতা হারান, যদি ইরান শেষ পর্যন্ত পরমাণু কর্মসূচি ত্যাগ করে—তাহলে ট্রাম্প বলতেই পারেন, “আমি করেছি যা কেউ করেনি।”

ইরান হয়তো ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াবে। যারা এখনও বেঁচে আছেন, সেই বিজ্ঞানীরা কর্মসূচিকে নিয়ে যাবেন মাটির নিচে, উত্তর কোরিয়ার পথ অনুসরণ করে। আজ উত্তর কোরিয়ার হাতে রয়েছে ৬০টিরও বেশি পরমাণু অস্ত্র। এত শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে, কেউ আক্রমণ করার সাহস পায় না।

ইরান ভাবতে পারে, “আমরাও তাই করব। অন্যথায় এই ভয়ানক হামলা আবার নামবে আমাদের আসমানে।”

এই হামলা একটি যুদ্ধ নয়—এই দাবি হয়তো মার্কিন প্রশাসনের, কিন্তু বাস্তবে এর অভিঘাত কতদূর যাবে, তা সময়ই বলবে। ট্রাম্প হয়তো জিতেছেন এক মুহূর্তের যুদ্ধ, কিন্তু পরিণতি কী হবে—তা এখনও অজানা। এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, ইরান কি পরমাণু স্বপ্ন ছাড়বে, নাকি এই আঘাত তাকে আরও কঠিন করে তুলবে?