গাজার চলমান যুদ্ধে নিহতদের বিশাল অংশ বেসামরিক নাগরিক ছিলেন, সাম্প্রতিক এক সামরিক প্রতিবেদনে এমন তথ্য ফাঁস হয়েছে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানাচ্ছে, দীর্ঘ প্রায় দুই বছরের ইসরাইলি হামলায় এখন পর্যন্ত অন্তত ৬২ হাজার ৬৮৬ জন নিহত এবং ১ লাখ ৫৭ হাজার ৯৫১ জন আহত হয়েছেন। বাস্তবে নিহতের সংখ্যা আরো অনেক বেশি হতে পারে বলে গবেষণায় ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।
প্রতিবেদনটি ইসরাইলের অভ্যন্তরীণ এক গোয়েন্দা ডাটাবেসের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, মে মাস পর্যন্ত ইসরাইল গাজায় মোট ৮ হাজার ৯০০ যোদ্ধাকে হত্যা করেছে। কিন্তু একই সময়ে নিহতের মোট সংখ্যা ছিল প্রায় ৫৩ হাজারজন। অর্থাৎ, নিহতদের মাত্র ১৬.৮ শতাংশ যোদ্ধা আর বাকি প্রায় ৮৩ শতাংশই বেসামরিক নাগরিক।
নিহতের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২২ মাসে ৬২ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। দ্য ল্যানসেট জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় বলা হয়েছে, নিহতের প্রকৃত সংখ্যা ঘোষিত সংখ্যার চেয়ে ৪০ শতাংশ বেশি হতে পারে। অনেকে ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছেন বা ইসরাইলি দখলকৃত অঞ্চলে মৃত্যুর পর উদ্ধার করা যায়নি।
ইসরাইলের অবস্থান
ইসরাইল বরাবরই দাবি করেছে, তারা বেসামরিক ক্ষয়ক্ষতি কমানোর চেষ্টা করে এবং গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান ‘অতিরঞ্জিত’।
ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহ সম্প্রতি দাবি করেন, আধুনিক নগরযুদ্ধের ইতিহাসে ইসরাইলই বেসামরিক ও যোদ্ধাদের মৃত্যুর মধ্যে সর্বনিম্ন অনুপাত বজায় রেখেছে।
তবে স্থানীয় গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ইসরাইলি সেনারা ল্যাভেন্ডার নামে এক এআই টার্গেটিং সিস্টেম ব্যবহার করেছে, যা হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে ‘সম্ভাব্য যোদ্ধা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এর ফলে প্রতিটি নিম্নপদস্থ হামাস সদস্যের জন্য ১৫-২০ জন বেসামরিক নিহত হওয়া ‘গ্রহণযোগ্য’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।
অন্যদিকে, ইসরাইলি সরকারের ডানপন্থী মন্ত্রীরা প্রকাশ্যে গাজাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস ও জনগণকে নির্বাসিত করার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।
মিডিয়া ও মানবাধিকার সংস্থার চিত্র
আল জাজিরা ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম নিয়মিতভাবে গাজায় বেসামরিকদের নির্বিচারে হত্যা, বাস্তুচ্যুত শিবিরে হামলা, স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার ধ্বংস এবং খাদ্যকে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের প্রমাণ প্রকাশ করেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই যুদ্ধের প্রকৃতি ছিল ‘গণহত্যামূলক’। এটি একটি পরিকল্পিত প্রক্রিয়া হিসেবে চালানো হচ্ছে।
ইসরাইলি সেনাবাহিনীর প্রতিক্রিয়া
ফাঁস হওয়া প্রতিবেদনের বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে ইসরাইলি সেনাবাহিনী এর অস্তিত্ব স্বীকার করলেও জানায় যে প্রকাশিত পরিসংখ্যান ‘ভুল’। তবে কোন অংশ ভুল বা কোন তথ্য তাদের সিস্টেমে ভিন্নভাবে নথিভুক্ত, তা স্পষ্ট করেনি।
ইসরাইলি সংখ্যার দ্বন্দ্ব
যুদ্ধের শুরু থেকে ইসরাইলি সেনাদের নিজেদের হিসাব বারবার পরিবর্তিত হয়েছে। কখনো তারা ২০ হাজার, কখনো ১৩ হাজার, আবার কখনো ১৭ হাজার যোদ্ধা হত্যার দাবি করেছে। এক গোয়েন্দা সূত্র পর্যন্ত স্বীকার করেছে যে নিহত অনেককে পরবর্তীতে ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যা দেয়া হয়, যা সংখ্যাকে বিভ্রান্তিকর করে তুলেছে।
আন্তর্জাতিক তুলনা
বিশ্বব্যাপী সশস্ত্র সঙ্ঘাতে বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম হলেও গাজায় নিহতদের ৮৩ শতাংশ বেসামরিক হওয়া অস্বাভাবিকভাবে বেশি বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।
ফাঁস হওয়া ইসরাইলি প্রতিবেদনের তথ্য ও গাজার বাস্তব পরিস্থিতি মিলিয়ে স্পষ্ট হয় যে ইসরাইলের দাবির বিপরীতে, গাজায় নিহতদের বিপুল অংশই বেসামরিক। এই বৈপরীত্য আন্তর্জাতিক মহলে ইসরাইলের যুদ্ধনীতি ও কর্মকাণ্ড নিয়ে গভীর প্রশ্ন তুলছে।
সূত্র : আল জাজিরা