জাতিসঙ্ঘের বিশেষ প্রতিবেদক ফ্রান্সেস্কা আলবানজে ইসরাইলের ক্রীড়া টিমগুলোকে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা থেকে বহিষ্কারের আহ্বান জানিয়েছেন।
পার্সটুডে জানিয়েছে, ইসরাইলে মানবাধিকারবিষয়ক জাতিসঙ্ঘের বিশেষ প্রতিবেদক ফ্রান্সেস্কা আলবানজে ইসরাইলি হামলায় এক ফিলিস্তিনি ফুটবল খেলোয়াড়ের প্রাণহানীর ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় এক্স সোশ্যাল নেটওয়ার্কে এক বার্তা প্রকাশ করেছেন, যেখানে ইসরাইলের কর্মকাণ্ডকে ‘গণহত্যা’ এবং ‘বর্ণবাদ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন এবং আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা থেকে ইসরাইলি সকল ক্রীড়া টিমকে বহিষ্কার করার আহ্বান জানিয়েছেন।
আলবানজে এর আগে বহুবার তার বার্তায় ইসরাইলি যুদ্ধবিমান হামলায় ফিলিস্তিনিদের হত্যার নিন্দা জানিয়েছিলেন। তার সর্বশেষ বার্তায় তিনি লিখেছেন, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা থেকে এই বর্বর খুনিদের বহিষ্কার করার সময় এসেছে। আসুন খেলাধুলাকে বর্ণবাদ এবং গণহত্যা থেকে মুক্ত করি।’
সংবাদ সূত্রে জানা গেছে, ইসরাইলি হামলায় ফিলিস্তিনি জাতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক ও সাবেক খেলোয়াড় সুলেইমান আল-ওবাইদ নিহত হয়েছেন। ফিলিস্তিনি জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক এই তারকা, যিনি ৪১ বছর বয়সী ছিলেন, ৬ আগস্ট বুধবার দক্ষিণ গাজা উপত্যকায় খাবার গ্রহণের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় ইসরাইলি সৈন্যদের হাতে নিহত হন।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ইসরাইল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বারা পরিকল্পিত ত্রাণ বিতরণের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের গাজা উপত্যকার নির্দিষ্ট স্থানে যেতে বলে সেখানেই চারদিক থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষদের ওপর গুলি ও বোমাবর্ষণ করেছে। খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা গ্রহণের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েক ডজন ফিলিস্তিনি ইসরাইলি স্নাইপার বা ড্রোন হামলার শিকার হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো ত্রাণ কেন্দ্রে এই হামলার ঘটনাকে ‘মৃত্যুর ফাঁদ’ হিসেবে বর্ণনা করেছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, বিশেষ করে গাজায় মানবিক সঙ্কট তীব্র হওয়ার সাথে সাথে তৃণমূল পর্যায়ের নানা সংস্থা, মানবাধিকার সংস্থা এবং এমনকি কিছু সরকার এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সমর্থনে ইসরাইলের ক্রীড়াবিদদের বয়কটের জন্য বিশ্বব্যাপী আহ্বান জোরালো হয়েছে। এই বয়কটগুলো একটি বৃহত্তর আন্দোলনের অংশ যা সাংস্কৃতিক, বৈজ্ঞানিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও পরিচালিত হচ্ছে।
২০২৪ সালের মে মাসে এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশন ইসরাইলকে ফিফা থেকে বহিষ্কারের আহ্বান জানিয়েছিল, কিন্তু এই অনুরোধের ব্যাপারে এখনো ফিফার থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে সাড়া পায়নি। ইসরাইলি খেলোয়াড় দলের বিরোধিতার কারণে ইন্দোনেশিয়াকে ২০২৩ সালের ফিফা অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপ আয়োজনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। ইন্দোনেশিয়ার এই পদক্ষেপ দেশের অভ্যন্তরে ব্যাপক জনসমর্থন লাভ করে এবং ফিলিস্তিনের সাথে সংহতির প্রতীক হয়ে ওঠে। অবশ্য, গত কয়েক দশকে ১৯৭২ সালের মিউনিখ, ১৯৭৬ সালের মন্ট্রিল এবং ২০০০ সালের সিডনিসহ বেশ কয়েকটি অলিম্পিক গেমসে, কিছু দেশ ইসরাইলি ক্রীড়াবিদদের বর্জনের আহ্বান জানিয়েছিল।
ইসরাইলের বিরুদ্ধে ক্রীড়া বর্জনের প্রতি বিভিন্ন দেশের প্রতিক্রিয়া খুবই বৈচিত্র্যময় এবং রাজনৈতিক। কেননা এর সাথে ফিলিস্তিনের জনগণের দুর্দশার বিষয়টি জড়িয়ে আছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বব্যাপী এই প্রতিক্রিয়াগুলো তীব্রতর হয়েছে, বিশেষ করে গাজায় মানবিক সঙ্কট বৃদ্ধির পর। গাজায় মানবিক সঙ্কটের ছবি প্রকাশের পর ইউরোপে ইসরাইলি ক্রীড়াবিদদের উপস্থিতির বিরুদ্ধে জনমত গড়ে উঠেছে।
ইউরোপীয় ফুটবল ক্লাবগুলো ইসরাইলি খেলোয়াড়দের নিয়োগ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, জোনাথন কোহেনের পোলিশ দল লেগিয়া ওয়ারশতে নিয়োগের বিষয়টি ভক্তদের বিক্ষোভের কারণে বাতিল করা হয়েছিল। পশ্চিমা পার্লামেন্টগুলোতেও প্রতিবাদ হয়েছে। কিছু এমপিও ইসরাইলের সাথে ক্রীড়া সম্পর্ক পর্যালোচনার আহ্বান জানিয়েছেন।
দক্ষিণ আফ্রিকা, যার ইসরাইলি কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে; এমনকি ১৯৪৮ সালের জেনেভা গণহত্যা প্রতিরোধসংক্রান্ত কনভেনশন লঙ্ঘনের জন্য আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে ইসরাইলের বিরুদ্ধে মামলা করেছে, তারা ইসরাইলের ক্রীড়া বর্জনের আহ্বান জানিয়েছে। এই প্রসঙ্গে, দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রীড়াবিদ এবং নাগরিক সমাজ সংগঠনগুলো বারবার আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ইসরাইলকে বর্জনের আহ্বান জানিয়েছে।
এই প্রতিক্রিয়াগুলো থেকে বোঝা যায়, খেলাধুলা এখন কেবল প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র নয়। বরং রাজনৈতিক ও মানবিক প্রতিবাদ প্রকাশের একটি প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়েছে।
ইসরাইলের ক্রীড়া বর্জনের জন্য বিভিন্ন কারণ তুলে ধরা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে,
- গাজায় যুদ্ধাপরাধ : ২৩ মাসের যুদ্ধে শত শত ক্রীড়াবিদসহ ৬১ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন এবং এই অঞ্চলের ৯৫ শতাংশ ক্রীড়া অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে গেছে।
ফিলিস্তিনি ক্রীড়াবিদদের শহীদ : ‘সুলেমান আল-ওবাইদ’সহ, ফিলিস্তিনি জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক, যিনি খাবার গ্রহণের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
- ইসরাইলকে বৈধতা দেয়ার ক্ষেত্রে খেলাধুলার ভূমিকা : অনেকেই বিশ্বাস করেন যে বিশ্বব্যাপী ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ইসরাইলের উপস্থিতি ইসরাইলের কর্মকাণ্ডকে বৈধতার দেয়ার প্রমাণ এবং এটি বন্ধ করা উচিত।
অবশ্য, ইসরাইলকে বয়কট করার আহ্বান সকল ক্ষেত্রেই বিদ্যমান এবং গত ২ বছরে গাজা যুদ্ধে ইসরাইলের অপরাধ অব্যাহত থাকায় তা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা ইসরাইলকে বয়কটের আহ্বান জানিয়ে অনলাইন প্রচারণা এবং প্রতিবাদ সমাবেশ শুরু করেছে। কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ইসরাইলের সাথে একাডেমিক সহযোগিতাও স্থগিত করেছে, যা ইঙ্গিত দেয় যে এই আন্দোলন খেলাধুলার বাইরেও বিস্তৃত হয়েছে।
সূত্র : পার্সটুডে