‘সন্ত্রাসমুক্ত তুরস্ক’

এরদোগানের সাফল্যের পেছনে ৩ কারণ

‘সন্ত্রাসমুক্ত তুরস্ক’ প্রকল্প শুধু নিরাপত্তা নয়, বরং গভীর রাজনৈতিক, সাংবিধানিক ও সামাজিক রূপান্তরের একটি সূচনা। এর বাস্তবায়ন কেবল কুর্দি প্রশ্নের সমাধান নয়, বরং তুরস্কের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সামাজিক শান্তি ও জাতীয় ঐক্যের পথ প্রসারিত করতে পারে।

নয়া দিগন্ত অনলাইন
তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান
তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান |সংগৃহীত

তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেপ এরদোগান ঘোষণা করেছেন, তুরস্ক নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে এক নতুন যুগে প্রবেশ করছে। গত ১২ জুলাই আঙ্কারায় জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির (একে পার্টি) ৩২তম সভায় এমন মন্তব্য করেন তিনি।

তিনি ‘সন্ত্রাসমুক্ত তুরস্ক’ প্রকল্পের নতুন পর্ব শুরু করার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন, যার মধ্যে কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি (পিকেকে) ভেঙে দেয়া, সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধ করা এবং অস্ত্র সমর্পণের লক্ষ্যে বাস্তব পদক্ষেপ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

এই ঘোষণার একদিন আগে উত্তর ইরাকে একটি প্রতীকী প্রদর্শনীতে পিকেকে তার অস্ত্র হস্তান্তর ও পুড়িয়ে ফেলা শুরু করে, যা এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা বলে বিবেচিত হচ্ছে। তবে এই প্রক্রিয়ার মূল ভিত্তি তৈরি হয়েছিল গত অক্টোবরে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন পার্টি (এমএইচপি) নেতা ডেভলেট বাহচেলির রাজনৈতিক আহ্বানে। যদিও সরকারি বিবৃতিগুলো সংযত ও সতর্ক ছিল, বাস্তব পদক্ষেপের অগ্রাধিকার স্পষ্ট ছিল।

এরদোগানের নেতৃত্বাধীন নতুন উদ্যোগটি পূর্ববর্তী ব্যর্থ প্রচেষ্টাগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে এগোচ্ছে। বিশেষ করে একে পার্টির শাসনামলে ওকালানের নেতৃত্বাধীন অস্ত্র সমর্পণের প্রক্রিয়াটি দ্রুতই ভেঙে পড়ে এবং ২০১৪ সালে সিরিয়ার পরিস্থিতি পিকেকে’র সশস্ত্র কার্যক্রমকে পুনরুজ্জীবিত করে।

সাফল্যের তিনটি প্রধান কারণ

১. তুর্কি রাষ্ট্রের উন্নত নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সক্ষমতা

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশেষ করে ড্রোন প্রযুক্তিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি তুরস্ককে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে এসেছে। ২০১৫ সালে পিকেকে কর্তৃক ঘোষিত স্বায়ত্তশাসিত প্রশাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার পর তুরস্ক এখন একটি পূর্বপরিকল্পিত যুদ্ধ কৌশলের মাধ্যমে ইরাক, সিরিয়া ও নিজ ভূখণ্ডে পিকেকে ও এর সহযোগীদের ক্ষমতা দুর্বল করতে সক্ষম হয়েছে।

২. ওকালানের অবস্থানের পরিবর্তন

পিকেকে-এর প্রতিষ্ঠাতা আবদুল্লাহ ওকালান ইমরালি দ্বীপে বন্দিত্ব থেকেই একটি চিঠির মাধ্যমে দলের আদর্শ ও কৌশল নিয়ে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি পেশ করেন। তিনি স্বীকার করেন যে বর্তমান আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রকল্প আর জনসমর্থন পায় না এবং দলীয় লক্ষ্যসমূহ বাস্তবতা থেকে দূরে সরে গেছে।

৩. আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বাস্তবতা তুরস্কের পক্ষে

তুরস্ক-ইরাক সহযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ইরাক সরকার পিকেকে-কে নিষিদ্ধ করেছে। সিরিয়ায় নতুন শাসনব্যবস্থার সাথে আঙ্কারার ঘনিষ্ঠতা এসডিএফ-কে প্রতিরক্ষামূলক অবস্থানে ঠেলে দিয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার ও এসডিএফ নিয়ে রাষ্ট্রদূতের সাম্প্রতিক অবস্থান সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক চিত্র তুরস্কের অনুকূলে বদলেছে।

পরবর্তী ধাপ : অস্ত্র সমর্পণ থেকে সাংবিধানিক পথে

আঙ্কারা বর্তমানে দেশের সবচেয়ে জটিল অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত সঙ্কটের সমাধানের দ্বারপ্রান্তে। এরদোগান স্পষ্ট করেছেন, এই পথ কোনো দর কষাকষির ফসল নয়। বরং নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার রাষ্ট্রীয় প্রয়াস। রাজনৈতিকভাবে এটি সকল পক্ষের জন্য লাভজনক, যেখানে সামরিক পথ ছিল সকলের জন্য ক্ষতিকর।

এই প্রক্রিয়ায় কুর্দিদের জন্য অধিক অধিকার ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, যা পূর্ববর্তী সংস্কারগুলোরই ধারাবাহিকতা। সাংবিধানিক ও আইনি কাঠামোর মাধ্যমে কুর্দি জনগোষ্ঠীর দাবি পূরণের পথ তৈরি হচ্ছে।

প্রক্রিয়াটির ভবিষ্যৎ ধাপে একটি নতুন সংবিধান বা সংশোধনী অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। এতে নাগরিকত্ব, অধিকার, সমতা এবং সংখ্যালঘু অধিকার অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। এছাড়া, পিকেকে সদস্যদের জন্য সাধারণ ক্ষমা, সমাজে পুনঃএকীভূতকরণ এবং অবস্থানভেদে ভিন্ন আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতে পারে।

তবে একে বাস্তবায়নের জন্য সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ বা অন্তত ৬০ শতাংশ ডেপুটির সমর্থন প্রয়োজন। বর্তমানে একে পার্টি, এমএইচপি ও কুর্দি এইচডিপি মিলিয়ে ৩৭৫ জন ডেপুটি রয়েছে, যা একটি জনপ্রিয় গণভোটে পাঠানোর মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত করে। এইচডিপি ওকালানের বার্তার মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করেছে। এই আইনি প্রক্রিয়ায় তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও রেখেছে।

চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যতের প্রশ্ন

যদিও পরিস্থিতির অনেক অগ্রগতি হয়েছে। তবে প্রক্রিয়াটি এখনো কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে। যেমন, পিকেকে’র ভেতরের কিছু দল অস্ত্র সমর্পণে অনিচ্ছুক থাকতে পারে। অথবা ইসরাইলসহ বাইরের শক্তিগুলো প্রক্রিয়াটি ব্যাহত করতে চাইতে পারে। তবে রাজনৈতিক গতিশীলতা ও বাস্তব পদক্ষেপের ধারাবাহিকতা এসব ঝুঁকিকে কমিয়ে দিয়েছে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হলো, এই প্রক্রিয়া আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সাথে কিভাবে সম্পর্কিত হবে? এরদোগান দাবি করেছেন, এটি তার ব্যক্তিগত নির্বাচনী কৌশলের অংশ নয়। তবে একে পার্টির মুখপাত্র ও এমএইচপি নেতা স্পষ্ট করেছেন যে তারা এরদোগানকে আবারো প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে চান। যদি সংসদ আগাম নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেয় বা নতুন সংবিধানে বিধান থাকে, তবে এরদোগান আবারো বৈধভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন।

‘সন্ত্রাসমুক্ত তুরস্ক’ প্রকল্প শুধু নিরাপত্তা নয়, বরং গভীর রাজনৈতিক, সাংবিধানিক ও সামাজিক রূপান্তরের একটি সূচনা। এর বাস্তবায়ন কেবল কুর্দি প্রশ্নের সমাধান নয়, বরং তুরস্কের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সামাজিক শান্তি ও জাতীয় ঐক্যের পথ প্রসারিত করতে পারে।

সূত্র : আল জাজিরা