ফিলিস্তিনের দখলদার গোষ্ঠীর ওপর ইরানের বিশতম দফার ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইতিহাসের পাতায় প্রথমবারের মতো ব্যবহৃত হলো বহুমুখী বোমাবাহী বা মাল্টিপল ওয়ারহেডস 'খাইবার জয়ী' ক্ষেপণাস্ত্র। ইসলামি বিপ্লবী রক্ষী বাহিনী বা আইআরজিসি ঘোষণা করেছে, এই নতুন প্রজন্মের বলিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে তারা শত্রুপক্ষের ভিত্তি কাঁপিয়ে দিয়েছে। আাইআরজিসি'র বরাত দিয়ে এ খবর দিয়েছে ইরানের তাসনিম সংবাদ সংস্থা।
এক বিবৃতিতে আইআরজিসি'র জনসংযোগ বিভাগ সকল শক্তির উৎস একমাত্র আল্লাহ, যিনি সর্বোচ্চ ও পরাক্রমশালী উল্লেখ করে জানিয়েছে, ‘অপারেশন সাদিক প্রতিশ্রুতি ৩’-এর বিশতম ঢেউ শুরু হয়ে ৪০টি কঠিন জ্বালানি ও তরল জ্বালানিচালিত ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের মধ্য দিয়ে। এই দফার সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক ছিল ‘ফাত্তেহ খাইবার' বা 'খাইবার জয়ী' নামের তৃতীয় প্রজন্মের বহুমুখী বোমাবাহী ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যবহার। সাধারণভাবে এই ক্ষেপণাস্ত্র খাইবার নামে পরিচিত। এই ক্ষেপণাস্ত্রে বহন করা প্রতিটি ওয়ারহেড বা বোমা ছিল আলাদা আলাদা লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। এর পদরিচালনা ছিল নতুন কৌশলে ফলে হয়ে উঠেছে আরও নিখুঁত, ধ্বংসাত্মক ও কার্যকর।
এবারের হামলার ঢেউয়ে ইসরাইলের বেন গুরিয়ন বিমানবন্দর, জৈবি গবেষণা কেন্দ্র এবং বিকল্প কমান্ড ও নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রসমূহকে নিশানা বানানো হয়। ক্ষেপণাস্ত্রের বোমগুলোও ‘ম্যানুভারিং সক্ষম।’ অর্থাৎ আঘাত হানার মুহূর্তে দিক পরিবর্তন করতে পারে এবং গাইডেড সিস্টেমের বা দিকনির্দেশনার মাধ্যমে নিখুঁতভাবে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে। প্রতিটি বোমায় পোরা ছিল ভিন্ন ভিন্ন জাতের উচ্চ-বিস্ফোরণ ক্ষমতাসম্পন্ন এবং ভয়াবহ ধ্বংস করার উপযোগী উপাদান।
হামলার সময় ইসরাইলের একাধিক এলাকা জুড়ে সতর্ক সংকেত বেজে ওঠে। এদিকে লক্ষ্যবস্তুতে বোমাগুলো সরাসরি আঘাত হানার পরপরই ইসরাযইলি নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ব্যাপক বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। ইরানি বাহিনী জানিয়ে দিয়েছে, এখনো তাদের সামরিক শক্তির মূল অংশ এই লড়াইয়ে ব্যবহারই করা হয়নি। আইআরজিসি তার বিবৃতিতে বলেছে, "বিজয় আসে শুধু আল্লাহর পক্ষ থেকেই, যিনি মহাপরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাবান।"
"খাইবার" নামটি এসেছে খাইবার দুর্গ থেকে—একটি ঐতিহাসিক যুদ্ধ যেখানে হজরত আলী করমুল্লার নেতৃত্বাধীন মুসলমান বাহিনী বিজয় অর্জন করেছিল। "খাইবার জয়ী" নামটি ইরান বেছে নিয়েছে প্রতীকী শক্তি ও প্রতিরোধের প্রতিচ্ছবি হিসেবে।
এই ক্ষেপণাস্ত্র শুধু একটি যুদ্ধাস্ত্র নয়—এটা এক গল্প, এক সংকেত, এক ভয়ংকর প্রতিজ্ঞা। মরুভূমির বুকে জন্ম নিয়ে সে আজ কাঁপিয়ে দেয় আকাশের দূর প্রান্ত।
খাইবার জয়ী… ইরানের আকাশজয়ী উত্তর।
‘খাইবার' হচ্ছে আইআরজিসির উন্নত তৃতীয় প্রজন্মের বলিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, যা একাধিক ওয়ারহেড বা বোমা বহনে সক্ষম এবং এগুলোকে পৃথক পৃথক লক্ষ্যবস্তুর দিকে গাইড বা দিক নির্দেশ করার প্রযুক্তি রয়েছে। এই ক্ষেপণাস্ত্র বসানো যায় মাল্টিপল ওয়ারহেড বা বহুমুখী একাধিক বোমা। এ সব বোমা বা ওয়ারহেডের ওজন প্রায় ১,৫০০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। খাইবার ক্ষেপণাস্ত্রে প্রাথমিক পাল্লা ২০০০ কিলোমিটার। অর্থাৎ তেহরান থেকে ছোড়া হলে সহজেই পৌঁছে যেতে পারে ইসরায়েলের যেকোনো জায়গায়। খাইবার হলো এক ধরনের মাঝারি পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র বা এমআরবিএম। এই ক্ষেপণাস্ত্রের আরেক নাম খোররামশাহর-৪। এটি মূলত ইরানের পুরোনো ক্ষেপণাস্ত্র সিরিজের আধুনিক উন্নত সংস্করণ।
একে ইরানের সবচেয়ে ভারী ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর একটি হিসেবে গণ্য করা হয়। খাইবার ক্ষেপণাস্ত্রটি ২০২৩ সালের মে মাসে ইরান প্রথমবারের মতো উন্মোচন করে। আইআরজিসি-এর হাতে নির্মিত ও পরিচালিত। জ্বালানি ভর্তি অবস্থায় দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায়, ফলে প্রয়োজনে দ্রুত ব্যবহার সম্ভব এই ক্ষেপণাস্ত্র।
পশ্চিম এশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্রের প্রতিযোগিতায় এই প্রজন্মের ক্ষেপণাস্ত্রকে যুগান্তকারী সংযোজন হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, ইরান এই আক্রমণের মাধ্যমে শুধু সামরিক নয়, কৌশলগত বার্তাও পাঠিয়েছে— তারা এখন যুদ্ধক্ষেত্রে একধাপ এগিয়ে এবং ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা অনেকটাই অনিশ্চয়তায় ভুগছে।
এই ঘটনায় পশ্চিম এশিয়ার ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা আরও বেড়ে গেল, এবং ইরান প্রমাণ করল— তাদের সামরিক সক্ষমতা কেবল রক্ষণাত্মক নয়, আক্রমণাত্মক অভিযানেও যথেষ্ট প্রস্তুত ও শক্তিশালী।