কাতারের রাজধানী দোহায় যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাবিত চুক্তি পর্যালোচনায় বসেছিলেন হামাসের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল। সেখানে দৈবাৎ আক্রমণ করে বসে ইসরাইলি বিমান। এটি ঘটনা আমাদের এই বার্তা দেয় যে বর্তমানে পৃথিবীতে আর কোনো নিরাপদ স্থান নেই।
প্রবন্ধের শুরুতেই আমি একটি প্রশ্ন করি। তবে লেখার শেষ দিকেও এই প্রশ্নটা ওঠে আসবে। ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্যকে সর্বোচ্চ কী হুমকি দিতে পারে? সর্বোচ্চ বলতে পারে যে তোমাদের সবাইকেই আমি একে একে টার্গেট করব।
দেখুন, কাতার আন্তর্জাতিকভাবেই মধ্যস্ততাকারী পক্ষ হিসেবে পরিচিত। বিভিন্ন সঙ্কট সমাধানে এবং নিরপেক্ষতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে তার প্রচেষ্টা স্বীকৃত। তাদের কোথাও কোনো আগ্রাসনের রেকর্ড নেই। তথাপি সেখানে শান্তিচুক্তিবিষয়ক একটি আলোচনা সভায় ইসরাইলি হামলা আমাদের এই বার্তায় দেয় যে ইসরাইল প্রতিটি মুসলিম বিশ্বকে চূড়ান্ত পর্যায়ের ঘৃণা করে।
সুতরাং বলা যায়, ইসরাইলের এই উন্নাসিকতা কেবল তার প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথেই নয়। বরং হাজার হাজার মাইল দূরের দেশগুলোও তার টার্গেটের মধ্যে রয়েছে। এমন একটা দিন আসবে, যখন সে ঠিকই সবাইকে হামলা করবে। এই বাস্তবতা বুঝার জন্য বড় কোনো গোয়েন্দা তথ্যেরও দরকার নেই। আবার গভীর কৌশলগত বিশ্লেষণেরও দরকার নেই। কী বলেন, বিষয়টি কি এমন নয়?
এখন নিন্দাজ্ঞাপনই যথেষ্ট নাকি বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ নেয়া জরুরি
এই পর্যন্ত ইসরাইল অন্তত আটটি আরব দেশের উপর হামলা করেছে। এর মধ্যে রয়েছে গাজা, লেবানন, সিরিয়া, ইরাক, ইরান, ইয়েমেন, কাতার ও তিউনিসিয়া। এই যে আটটি দেশের উপর ইসরাইল একে একে হামলা করলো। এর প্রতিবাদে এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
সম্প্রতি আরব নেতাদের ডাকা জরুরি সম্মেলনে উপস্থিত এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, অন্তত এবার তো বুঝা গেল যে পরিস্থিতি বড় ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এখনই মুসলিম বিশ্বের পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। হতে পারে এই অনুভূতিই পরবর্তীতে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে এবং প্রতিক্রিয়া জানাতে সাহায্য করবে।
হয়তো এটিই আমাদের সান্ত্বনার একমাত্র উপায়। আশা ছাড়া আর আমরা কী-ই বা করতে পারি।
আমি এই প্রবন্ধ লেখার সময় ওই কর্মকর্তাকে বলেছিলাম, ইসরাইল মুসলিম দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হতে এর চেয়ে বেশি আর কী করতে পারে? তিনি এর কোনো সদুত্তর দিতে পারলেন না। হয়তো যখন প্রত্যেকের উপর আলাদা আলাদাভাবে ইসরাইল হামলা করা সম্পন্ন করে ফেলব, তখন তাদের ঘোর কাটবে এবং তখন হয়তো কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
সড়কগুলো উত্তপ্ত, কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ নিশ্চুপ
গাজার আগ্রাসনে মানুষজন ক্ষুব্ধ। বিশেষ করে কাতারে ইসরাইলি হামলার পর বিভিন্ন দেশের কার্যকর পদক্ষেপের প্রতি মানুষের আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছে।
গাজার অবরোধ ভাঙতে যাত্রা করা ‘রেজিলিয়েন্স ফ্লোটিলা’য় অংশগ্রহণকারী ইতালির এক সাংবাদিক বলেন, ইসরাইলের এমন নৃশংস কর্মকাণ্ডে ইতালির মানুষজন খুবই ক্ষুব্ধ। তারা যখন জানতে পারলেন যে আমরা গাজা উদ্দেশে জাহাজ ছাড়ছি, রাস্তায় রাস্তায় তারা আমাদের অনেক সম্মান জানিয়েছে।
এই ফ্লোটিলায় অংশগ্রহণকারী স্পেনের এক অ্যাক্টিভিস্ট বলেন, বর্তমানে গাজা ইস্যুতে অনেক মুসলিম দেশ থেকেও স্পেন বেশি সরব। প্রধানমন্ত্রী থেকে একদম সাধারণ নাগরিক পর্যন্ত সবাই ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমব্যথী এবং ইসরাইলের প্রতি ক্ষুব্ধ।
একই অভিব্যক্তি জানিয়েছে অন্যান্য দেশের হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবীর। এমনকি অনেক অমুসলিম অ্যাক্টিভিস্টরাও জীবন হাতে নিয়ে গাজাগামী ফ্লোটিলায় অংশগ্রহণ করছে।
এখন প্রশ্ন হলো, আমাদের মুসলিম দেশগুলো কেন এই ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে না? আসলে সাধারণ মানুষের কাছে এর উত্তর নেই। সেজন্যই তারা এই বিপজ্জনক উপায়ে নাগরিক সংহতি প্রকাশ করা এবং প্রাণোৎসর্গের নাজরানা দেয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ হয়েছে।
ভূমধ্যসাগরের তীরে ফ্লোটিলাকে অভিনন্দন
ভূমধ্যসাগরের উপকূলীয় তুর্কি শহর মেরসিনের পানিসীমা দিয়ে যখন
রেজিলিয়েন্স ফ্লোটিলা পার হচ্ছিল, তখন সেখানে অনেক মানুষ একত্রিত হয়। তাদের অনেকেই তখন তীর থেকে নৌকা নিয়ে তাদের সাথে প্রতীকী যাত্রা করে সম্মানিত করে।
প্রতীকী সম্মান প্রদর্শনকারীদের নেতৃত্বদানকারী একজন শিক্ষক বলেছেন, আমি গাজার জন্য কিছুই করতে পারছি না। এই অনুভূতিই আমার ঘুম হারাম করে দিয়েছে। সেজন্য আমি সবাইকে বলেছি, আমরা না হয় কিছুই করতে পারছি না। চলো, অন্তত এই সাহসী লোকগুলোকে সালাম জানিয়ে আসি।
এমন লাখ লাখ মানুষ আছেন, যারা গাজার জন্য কিছু করতে না পেরে ছটফট করছেন। কেনই বা ছটফট করবে না। গাজায় আজ শিশুরা খেতে না পেয়ে মারা যাচ্ছে। তাদের জন্য যাদের চিন্তা হয় না, তাদেরকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা উচিৎ।
গোটা বিশ্বে ফিলিস্তিনি পতাকা উড়ছে
বিশ্ব আগে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি, যা এভাবে গোটা বিশ্ববাসীর মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে। অস্ট্রেলিয়া থেকে ব্রিটেন, ফিনল্যান্ড থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে ফিলিস্তিনিদের আর্তনাদ। শত শত দেশের লাখ লাখ মানুষ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই এখন ফিলিস্তিনি পতাকা উড়াচ্ছে।
আসলে গত কয়েক দশকে ফিলিস্তিনি ইস্যুকে এতটা আলোচিত দেখা যায়নি। মানুষকেও এত সংহতি জানাতে দেখা যায়নি। এমনকি ইতিহাসেও স্বাধীনতার এমন কোনো রেকর্ড নেই, যা এই পরিমাণ আন্তর্জাতিক সমর্থন পেয়েছে।
এটি এমন একটি ইস্যু যাতে মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, অ-জায়নবাদী ইহুদি এবং নাস্তিক সবাই ঐক্যবদ্ধ। সবাই এতে অন্তর থেকে একতাবদ্ধ। সেজন্য এটি আর কেবল হামাস বা ফিলিস্তিন কিংবা মুসলমানদের বিষয় হিসেবে থাকেনি। বরং এটি এখন জালেম ও মাজলুজের মধ্যকার একটি যুদ্ধের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এজন্য এই ইস্যুতে অমুসলিমরাও জীবন বিপন্ন করতে দ্বিধা করছে না।
শেষ প্রশ্ন
এহেন পরিস্থিতিতে সবাই মুসলিমদের নেতাদের থেকে সুনির্দিষ্ট ও শক্তিশালী পদক্ষেপ আশা করছে। তারা প্রশ্ন করছে, গাজায় ৬৫ হাজার বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যু, ক্ষুধার যন্ত্রণায় শিশুদের তিরোধান এবং জাতিগত নিধান কি ইসরাইলের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়ার জন্য যথেষ্ট নয়? এমনকি আটটি আরব মুসলিম দেশে হামলার পরও নয়? এমনকি কাতারের মতো নিরপেক্ষ ও মধ্যস্থতাকারী পক্ষের উপর হামলার পরও নয়? এহেন পরিস্থিতি কি জরুরি অবস্থা জারির জন্য যথেষ্ট নয়?
শুরুতে যে প্রশ্নটি করেছিলাম, এখন সেই প্রশ্ন করছি, আসলে ইসরাইল সর্বোচ্চ কী করতে পারে? হয়তো সর্বোচ্চ বলতে পারে- আমি একদিন না একদিন তোমাদের সবার উপরই হামলা করবো।
তাহলে তাদের এই হুমকির মোকাবেলায় আপনাদের কী করা উচিৎ? এখনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আর কিসের অপেক্ষা করছেন?
সূত্র : আল জাজিরা