ইরানের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনাসহ আবাসিক এলাকায় গত মাসে আকস্মিক বিমান হামলা চালিয়েছিল ইসরাইল। এতে বেশ কয়েকজন ইরানি সামরিক নেতা নিহত হয়েছেন, ইরানের প্রতিরক্ষামূলক সামরিক ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়েছে। এক পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রও ইসরাইলের পক্ষ নিয়ে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা ফোরদোতে হামলা করে। ইরানের সাথে ১২ দিনের এই যুদ্ধকে সাফল্য হিসেবেই দেখছে ইসরাইলের নেতৃত্ব।
ইসরাইলি নেতারা জোর দিয়ে বলেছেন, প্রয়োজনে তারা আবারো আক্রমণ করতে প্রস্তুত। এদিকে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বক্তব্য, তার ‘উত্তেজনা কমানোর কোনো ইচ্ছা নেই’।
বিশ্লেষকরা আল জাজিরাকে বলছেন, ইরানে ইসলামী প্রজাতন্ত্রের পতনের লক্ষ্যে ইসরাইল ইতোমধ্যেই আরেকটি ধ্বংসাত্মক সংঘাত শুরু করার পরবর্তী সুযোগ খুঁজছে। তবে, তা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ‘অনুমতি’ প্রয়োজন হবে। যুক্তরাষ্ট্র অনুমতি দিতে রাজি না-ও হতে পারে।
এই সপ্তাহের শুরুতে আল জাজিরাকে সাাক্ষাৎকার দেয়ার সময় ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান বর্তমান যুদ্ধবিরতি কতদিন বহাল থাকবে তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা যেকোনো নতুন ইসরাইলি সামরিক পদক্ষেপের জন্য সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত। আমাদের সশস্ত্র বাহিনী আবারো ইসরাইলের গভীরে আঘাত হানতে প্রস্তুত।’
যুদ্ধের উদ্দেশ্য
ইসরাইল জোর দিয়ে বলেছিল, তারা ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোকে ধ্বংস করতে হামলা চালিয়েছে। তবে তাদের এই হামলা মূলত ইরানের উচ্চপদস্থ সরকারী ও সামরিক কর্মকর্তাদের হত্যার মাধ্যমে দেশটির শাসনব্যবস্থা দুর্বল এবং সম্ভাব্য পতন ঘটানোর প্রচেষ্টার ইঙ্গিত দেয়।
নেতানিয়াহু সেই অভিযান পুনরায় শুরু করার সুযোগ খুঁজছেন। এমনটাই মনে করছেন ইরানবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও বামঘেঁষা মার্কিন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান কুইন্সি ইনস্টিটিউটের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট ত্রিতা পারসি।
তিনি আল জাজিরাকে বলেন, ইসরাইলের আবার হামলা চালাতে চাওয়ার পেছনে কারণ হলো তারা চায় ইরানকে সিরিয়া বা লেবাননের মতো বানাতে। যেখানে ইসরাইল কোনো রকম জবাবদিহি ছাড়াই যেকোনো সময় হামলা চালাতে পারে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইউরোপীয় দেশগুলো আবার ইরানের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে সেটি ইসরাইলের জন্য আরেকটি যুদ্ধের সুযোগ তৈরি করতে পারে।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও জুলাইয়ের শুরুতে জার্মানি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সাথে ফোনালাপে একমত হয়েছেন যে আগস্টের শেষের মধ্যে নতুন পারমাণবিক চুক্তিতে সম্মত না হলে জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের নিষেধাজ্ঞা ইরানের ওপর পুনরায় আরোপ করা হবে। ইরান ও বেশ কয়েকটি পশ্চিমা দেশ পারমাণবিক চুক্তিতে সম্মত হলে ২০১৫ সালে নিষেধাজ্ঞাগুলো তুলে নেয়া হয়।
ত্রিতা পারসি সতর্ক করে বলেন, ২০১৮ সালে ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের দুই বছর পর যুক্তরাষ্ট্র সেই চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসে এবং সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগের অংশ হিসেবে নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহাল করে। এখন চুক্তিতে থাকা ইউরোপীয় পক্ষগুলোও একই পথ অনুসরণ করতে পারে। এটি ইরানকে পরামণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি থেকে বেরিয়ে যেতে প্ররোচিত করতে পারে। ফলে ইরানে আবারো হামলার জন্য ইসরাইলের পথ প্রশস্ত হবে।
তবে ইসরাইলের রাইখমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইরানবিষয়ক অধ্যাপক মেইর জাভেদানফার বলেন, যুদ্ধ করতে চাইলে ইসরাইলকে এমন বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ দিতে হবে যা ইঙ্গিত দেয়, ইরান আবার তার পরমাণু কর্মসূচি চালু করছে। যুক্তরাষ্ট্র ও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অনুমতি ছাড়া ইসরাইলের পক্ষে যুদ্ধ শুরু করা কঠিন হবে।
ইসরাইলের গোপন অভিযান
ইসরাইলের আরেকটি বড় আক্রমণ খুব শিগগির না হলেও গত বুধবার নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরাইল ইতোমধ্যে ইরানে নাশকতামূলক গোপন অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে।
সংবাদমাধ্যমটি তিনজন কর্মকর্তা ও একজন ইউরোপীয় কূটনীতিকের সূত্রে জানিয়েছে, ইরানের বিভিন্ন অ্যাপার্টমেন্ট ভবন, তেল শোধনাগার, বিমানবন্দরের পাশের এলাকা ও এক জুতা কারখানায় আকস্মিক বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের জন্য ইসরাইল দায়ী।
ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল পলিসির ইরানবিষয়ক বিশ্লেষক নেগার মরতাজাভি বলেন, ‘আমার মনে হয়, নেতানিয়াহু এমন একটি উপায় খুঁজে পেয়েছেন, যার মাধ্যমে তিনি ট্রাম্পের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার পরও নির্বিঘ্নে ইরানে হামলা চালাতে সক্ষম হবেন।’
গত জুনের সংঘাত শুরুর সময়ই ইরানের নিরাপত্তা ও পরিকাঠামোয় ইসরাইলের বিস্তৃত অনুপ্রবেশের প্রমাণ পাওয়া গেছে। স্থানীয় গোয়েন্দা সদস্য ও ইরানি ভূখণ্ড থেকেই ড্রোন হামলা চালিয়ে ইসরাইল বহু ইরানি লক্ষ্যে আঘাত হানে। ইরানবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ওরি গোল্ডবার্গ বলেন, যুদ্ধের সাথে সাথে ইরানের অভ্যন্তরে ইসরাইলের নেটওয়ার্ক শেষ হয়ে গেছে এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
নতুন যুদ্ধের সম্ভাবনা
নেতানিয়াহু আগে কিছুটা সংঘাতবিরোধী ছিলেন। এখন তিনি সিরিয়া, লেবানন, ইয়েমেন ও ইরানসহ আশপাশের দেশগুলোতে বারবার হামলা চালাচ্ছেন। এর পাশাপাশি গাজায় চালানো নিপীড়নের মাত্রাও বেড়েছে।
গাজা নিয়ে ইসরাইলের অভ্যন্তরে মতবিরোধ থাকলেও ইরানের বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য রয়েছে। ওরি গোল্ডবার্গ বলেন, ‘নেতানিয়াহু যদি মনে করেন তার অবস্থান বিপদের মুখে, তাহলে তিনি ইরানকে আঘাত করে জনগণকে আবার নিজের পক্ষে একত্রিত করার চেষ্টা করবেন।’
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরান দ্বিতীয়বার আর প্রস্তুতিহীন থাকবে না। নেগার মরতাজাভি বলেন, ‘ইরান জানে যে একটি কূটনৈতিক চুক্তি হলে ইসরাইল হামলার সুযোগ হারাবে। তাই তারা চায় আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টির সমাধান করতে।’
সূত্র : আল জাজিরা