মাঝ আকাশে উড়ছে না কোনো বোমারু বিমান। সীমান্তে নেই ট্যাংকের গর্জন। অথচ ইসরায়েলের অভ্যন্তরে একে একে নিভে যাচ্ছে যোগাযোগের বাতিগুলো। মাটির নিচে নয়, সাইবার জগতের গভীরে শুরু হয়েছে এক অভূতপূর্ব যুদ্ধ। যেখানে সৈনিকদের অস্ত্র মাউস আর কোড।
এই যুদ্ধের হালফিল চিত্র উঠে এসেছে ইরানের ঘনিষ্ঠ হ্যাকার গোষ্ঠী “সাইবার সাপোর্ট ফ্রন্ট”-এর টেলিগ্রাম বিবৃতিতে। তারা দাবি করেছে, “একটি বহুমাত্রিক সাইবার অভিযানের মাধ্যমে ইসরায়েলের সামরিক ও বেসামরিক সমস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।”
এটা কোনো একদিনের বদলা নয়। এটি বহু বছরের জমে থাকা ক্রোধ, প্রতিশোধ এবং প্রযুক্তির পরাক্রমে সজ্জিত এক ‘ডিজিটাল জিহাদ’।
এই আক্রমণের ভয়াবহতা বোঝাতে হ্যাকার গোষ্ঠীটি যে ছয়টি পয়েন্টে বিশ্লেষণ করেছে, তা যেন একটি পরিপূর্ণ রাষ্ট্রীয় কাঠামো ধ্বংসের রূপরেখা।
১. উপগ্রহ যোগাযোগ নেটওয়ার্ক ধ্বংস: ইহুদিবাদী ইসরাইলের “আমোস”, “ডর-১”, এবং “ওফেক” স্যাটেলাইটগুলোর নিয়ন্ত্রণ ও মনিটরিং স্টেশন ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। এই স্যাটেলাইটগুলো মূলত ইসরাইলের সামরিক নজরদারি, হামলার লক্ষ্যবস্তু নির্ণয় এবং আন্তঃবাহিনী যোগাযোগের মেরুদণ্ড।
২. সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা, ইসরাইলি ডিফেন্স ফোর্সের (আইডিএফ) অভ্যন্তরীণ রেডিও ও ইন্টারনাল কমান্ড চেইন ধ্বংস হয়েছে। ফলে কমান্ড থেকে সিপাহিদের কাছে নির্দেশ পৌঁছানোই অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
৩. গোয়েন্দা ও নজরদারি ইউনিটের নেটওয়ার্ক, মোসাদ ও সামরিক গোয়েন্দা ইউনিটগুলোর ইলেকট্রনিক ট্র্যাকিং ও মনিটরিং ব্যবস্থা অচল হয়ে গেছে। এখন তারা শত্রু চিহ্নিত করতেই হিমশিম খাচ্ছে।
৪. ইসরাইলি আর্মস কোম্পানিগুলোর নিয়ন্ত্রণ হারানো, এলবিট, রাফায়েল, ও আইএআই (ইসরায়েল অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ), এই তিনটি প্রতিষ্ঠান ইসরায়েলের যুদ্ধাস্ত্র তৈরির মেরুদণ্ড। এদের অভ্যন্তরীণ ডেটা ও নেটওয়ার্ক সিস্টেমে আঘাত হেনে, তাদের অস্ত্র নির্মাণ কার্যক্রম অচল করে দেওয়া হয়েছে।
৫. জীবনরক্ষা অবকাঠামোতে আঘাত, পানি সরবরাহ, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও গ্যাস বিতরণের কন্ট্রোল সিস্টেম হ্যাক করে ধ্বংস করা হয়েছে। এতে ইসরায়েলের সাধারণ জনগণের জীবনযাত্রা বিশৃঙ্খলায় পড়েছে।
৬. জাতীয় ও সরকারি নেটওয়ার্ক ধ্বংস, ইসরাইলের মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে প্রধামন্ত্রীল দপ্তর পর্যন্ত—ইসরায়েলের শাসনব্যবস্থার ‘ডিজিটাল মেরুদণ্ড’ ছিন্নভিন্ন করে দেওয়া হয়েছে।
এই অভিযানে কেবল ধ্বংসই নয়, গোপনে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে ৫০ টেরাবাইট তথ্য। ইসরাইলের জন্য এটি এক অপূরণীয় ক্ষতি। এ সব নথিতে রয়েছে,পরমাণু অস্ত্রের প্রকল্প নথি, ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তির ডিজাইন, সাইবার সুরক্ষা ব্যবস্থার গোপন কোড এবং কূটনৈতিক বার্তা ও আলোচনার রেকর্ড।
এ সব তথ্য এখন ইরানের ঘনিষ্ঠ হ্যাকার গোষ্ঠীর হাতে। শুধু সময়ের অপেক্ষা, এই তথ্য কখন, কোথায়, কীভাবে ব্যবহৃত হবে।
সাইবার সাপোর্ট ফ্রন্ট তাদের বিবৃতিতে দখলদার ফিলিস্তিনের জনগণের উদ্দেশে এক নির্মম বার্তা পাঠিয়েছে। বলেছে, তোমাদের সরকারের দাম্ভিকতা আজ চূর্ণবিচূর্ণ। ‘ডেভিড’স স্লিং’ বা ‘অ্যারো’-এর মতো কোটি কোটি ডলারের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও আজ ব্যর্থ। এখন থেকে তোমরা আর কারো উপর নির্ভর করতে পারো না। পুরো বিশ্ব আজ জেনে গেছে, ইসরায়েল ‘মাকড়সার জালের’ চেয়েও দুর্বল। মনে রেখো, তোমরা এখন একা। এই বিবৃতি নিছক হুমকি নয়, বরং মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের একটি কৌশল, যাতে জনগণের মনে ভয় ঢুকিয়ে তাদের অবৈধ শাসন কাঠামোকে আরও দুর্বল করা যায়।
এই যুদ্ধ আজকের নয়, এর শুরু ২০১০ সালে, যখন ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র মিলে স্টাক্সনেট নামের একটি অত্যাধুনিক কম্পিউটার ভাইরাস দিয়ে ইরানের নাতাঞ্জ পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস করেছিল। সে ছিল প্রথম ডিজিটাল যুদ্ধ, যেখানে পরমাণু প্রযুক্তি ধ্বংস হয়েছিল কোডের মাধ্যমে। এরপর পাল্টা আক্রমণ আসে ইরানি হ্যাকারদের হাত ধরে। "শামুন", "ডার্কসোল" এবং "ডেস্ট্রাক্টর"-এর মতো ভাইরাস দিয়ে। সৌদি আরব, কাতার, এমনকি আমেরিকান তেল কোম্পানিও এর শিকার হয়েছিল। এইসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে এক"অদৃশ্য ফ্রন্টলাইন" তৈরি হয়। যেখানে কোনো ব্যারিকেড নেই। নেই কাঁটাতারের বেড়া। কিন্তু আছে সর্বনাশা আঘাত।
এই সর্বশেষ হামলা যেন একটি প্রাক-ঘোষিত যুদ্ধ ঘোষণা। সাইবার সাপোর্ট ফ্রন্ট বলেছে, আমরা এখন থেকে ইসরায়েলের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোকে আমাদের বৈধ লক্ষ্য বলে ঘোষণা করছি। একটি সাইবার অবরোধ শুরু হচ্ছে।” এই ঘোষণার মানে দাঁড়ায়, ইসরায়েল এখন থেকে দিনে দিনে আরও বিচ্ছিন্ন, দুর্বল, এবং অকার্যকর হয়ে পড়বে।কেবল অস্ত্র দিয়ে নয়, ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন করেই এ কাজ সারা হবে।
ইসরাইলের নিরাপত্তা ভেঙে পড়ে মাউসের ক্লিকে। এই যুদ্ধের কোনও ধোঁয়া নেই। রক্ত নেই। কিন্তু ধ্বংস আছে। আতঙ্ক আছে। একটা সময় মানুষ রাষ্ট্র গঠনের ভিত্তি ভাবত সেনা, পুলিশ, পানি, বিদ্যুৎ ও আইন। আজ প্রমাণ হচ্ছে, ইন্টারনেট, তথ্য ও সাইবার সুরক্ষা না থাকলে একটি রাষ্ট্র দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। সীমানা ভাঙে না। কিন্তু দেশের ভিতরে সব কিছু বন্ধ হয়ে যায় বোমা পড়ে না কিন্তু বিদ্যুৎ বন্ধ, পানি বন্ধ, যোগাযোগ বন্ধ। সৈনিক মারা পড়ে না। কিন্তু রাষ্ট্র নিঃশব্দে অচল হয়ে পড়ে। যুদ্ধের ভাষা বদলে গেছে। এখন লড়াই হয় ‘এন্টার’ চাপার মাধ্যমে। এই যুদ্ধ শেখাচ্ছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা মানেই জাতীয় নিরাপত্তা। এবং সেই পাঠ সবচেয়ে করুণভাবে এখন শিখছে ইসরায়েল।