গাজার পক্ষে এতো সরব কেন স্পেন

স্পেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি। এছাড়া তারা কখনোই নিজেদের ভেতর এমন কোনো ইসরাইলি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনি, যাতে হোলোকাস্টে নির্যাতিত ও ইউরোপ থেকে বিতাড়িত ইহুদিরা আশ্রয় নিতে পারে।

নয়া দিগন্ত অনলাইন
স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ
স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ |আল জাজিরা

চলতি বছরের ৮ সেপ্টেম্বর স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ গাজায় চলমান নির্মূল অভিযানের সমালোচনা করে এক বিবৃতি দেন। সেখানে তিনি ইসরাইলের বিরুদ্ধে নিজের ও নিজের দেশের নাগরিকদের অসন্তোষ ব্যক্ত করেন।

সানচেজ বলেন, মাদ্রিদ হয়তো পারমাণবিক কোনো শক্তি নয়; তাদের কোনো বিমানবাহী রণতরী বা বিশাল তেলের জ্বালানিও নেই। একাকী হয়তো গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনের সামনে প্রবল বাধা হয়েও দাঁড়াতে পারবে না। তবে এর অর্থ এই নয় যে আমরা কোনো চেষ্টাই করব না। এখানে এমন কিছু ইস্যু আছে, যার জন্য এমনিতেই লড়াই করা যেতে পারে। এমনকি তাতে সফলতার কোনো সম্ভাবনা না থাকলেও কোনো লোকসান নেই।

সানচেজের এই বিবৃতি ইসরাইলের অভ্যন্তরে তুমুল বিতর্কের জন্ম দেয়। তারা এটাকে বিকৃতি করে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করে। বিষয়টিকে তারা ইসরাইলি রাষ্ট্র ধ্বংসের হুমকি হিসেবে উপস্থাপনের অপপ্রয়াস পায়।

এর প্রতিক্রিয়ায় ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এক বিবৃতিতে বলেন, মনে হচ্ছে যে স্প্যানিশ ইনকুইজিশন, স্পেনের ইহুদিদের বিতাড়ন এবং নাৎসি হোলোকাস্টও সানচেজের আত্মতৃপ্তির জন্য যথেষ্ট নয়।

ইসরাইলি পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিদিওন সায়ের স্পেনের উপর আক্রমণ করে বলেন, স্পেন তো ইহুদি নাগরিকদের বিরুদ্ধে করা তাদের অপরাধের ইতিহাসই মুছে ফেলেছে। যার মধ্যে স্প্যানিশ ইনকুইজিশন রয়েছে।

স্পেন ও ইসরাইলের মাঝে এমন পাল্টাপাল্টি বিবৃতি থেকেই অনুমান করা যায় যে সানচেজ ও তার দেশ দখলদার শক্তির জন্য কেমন বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মূলত সানচেজই একমাত্র ইউরোপীয় নেতা, যিনি এতটা স্পষ্ট ও দৃঢ়তার সাথে ইসরাইলের সমালোচনা করছেন।

সানচেজ কেবল প্রসিদ্ধ কর্মী, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব কিংবা জনমত গঠনকারী বিশিষ্ট ব্যক্তি বা ইউরোপের বড় নেতাই নন। বরং তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের একজন প্রভাবশালী প্রধানমন্ত্রীও বটে। গত বছর তিনি তার দেশকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী ৩৭ দেশের মধ্যে অন্যতম দেশে পরিণত করেছে। একইসাথে তিনি দেশের জিডিপি ও শেয়ারবাজারের সক্ষমতা বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বেকারত্ব ও সরকারি বাজেটের ঘাটতি দূরীকরণে সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন।

এর অর্থ হলো ইসরাইলের বিরুদ্ধে যে কণ্ঠস্বরটা উচ্চকিত হচ্ছে, তা কোনো দুর্বল কণ্ঠস্বর নয়। বরং তা নিজ দেশে সফল এবং তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নকে ফিলিস্তিনিদের ব্যাপারে ন্যায়নিষ্ঠ বানানোর চেষ্টা করছেন। অর্থাৎ এর প্রভাব কেবল স্পেনেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। বরং তা ক্রমেই ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে পড়েব। এমনিভাবে এটি ওই ক্ষীণ সরকারি কণ্ঠস্বর, যা ইউরোপে ডানপন্থী উগ্রপন্থা রোধের ভূমিকা রাখছে। সেজন্যই সানচেজের বিবৃতির জবাব দখলদাররা এমন আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে দিয়েছে।

অনেকের ধারণা, সানচেজ বামপন্থার প্রতি ঝুঁকে পড়ায় ইসরাইলের সমালোচনা ও ফিলিস্তিনের পক্ষে কথা বলেন। তাদের এই ধারণা আংশিক সত্য। তবে এই ইস্যুতে সানচেজের সংহতি আদায়ে স্পেনের ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার -যা সমালোচনার ঊর্ধ্বে- অনেকটা ভূমিকা রেখেছে বলেই প্রতীয়মান হয়।

এছাড়া ইউরোপে এখন ফিলিস্তিনিদের প্রতি জনসাধারণের ব্যাপক সহানুভূতি সৃষ্টি হয়েছে, যা ইসরাইলের প্রতি পক্ষপাতকে সমর্থন করে না। এটি ডান-বাম সবার মধ্যেই প্রবলভাবে কাজ করছে না। যদিও তা বামদের মধ্যেই বেশি প্রকাশ পাচ্ছে।

মাদ্রিদ বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজের অধ্যাপক ড. লুইস গুমেজ বলেন, স্পেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি। এছাড়া তারা কখনোই নিজেদের ভেতর এমন কোনো ইসরাইলি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনি, যাতে হোলোকাস্টে নির্যাতিত ও ইউরোপ থেকে বিতাড়িত ইহুদিরা আশ্রয় নিতে পারে।

অধিকন্তু যুদ্ধের সময় অক্ষশক্তির সাথে তাদের তুলনামূলক সম্পৃক্ততা এবং পরবর্তীকালের ইউরোপের সাথে তাদের বিচ্ছিন্নতা তাদেরকে দক্ষিণ ও পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক বজায় রাখতে অধিক আগ্রহী করে তোলে। এমনকি ১৯৭৫ সালো ফ্রাঙ্কোর শাসন পতনের পর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পরও তাদের এই আগ্রহ বহাল থাকে। স্পেন কখনোই আরব রাষ্ট্রগুলোর সাথে তাদের ঐতিহাসিক সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত হতে দেয়নি। এটিকে তারা ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে আসছে।

এজন্যই স্পেন সরকার ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলনের সাথে সম্পর্ককে সুদৃঢ় করেছে। এমনকি মাদ্রিদে ১৯৭৯ সালে তাদের একটি অফিসও খোলার অনুমতি দিয়েছিল। পাশাপাশি ইউরোপের প্রথম দেশ হিসেবে ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাতকেও স্প্যানিশ গণতন্ত্রের প্রথম প্রধানমন্ত্রী অ্যাডলফো সুয়ারেজ উষ্ণ সংবর্ধনা দিয়েছিলেন।

এমনকি ১৯৮৬ সালে যখন স্পেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ গ্রহণ করেছে, তখন ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়ার প্রসঙ্গ এলে স্পেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ফেলিপ গঞ্জালেজে আরব নেতাদের সাথে দীর্ঘ পরামর্শ করে এবং তৎকালীন আরব লীগের মহাসচিবের কাছে ব্যাখ্যামূলক চিঠি দিয়ে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়। এরপর ইইউ’র পদ গ্রহণ করে।

অবশ্য এরপর থেকে অর্থনীতি ও সামরিক পর্যায়ে স্পেন ও ইসরাইলের মাঝে সম্পর্কের অগ্রগতিও হয়েছিল। তবে মাদ্রিদ ফিলিস্তিনের সাথে তার ঐতিহাসিক সম্পর্কের কথা ভুলে যায়নি। যেমন ২০১২ সালের নভেম্বরে যখন ফিলিস্তিনকে যুক্তরাষ্ট্রের জাতিসঙ্ঘের ‘অ-সদস্য পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র’ হিসেবে স্বীকৃতির কথা উঠেছিল, তখন মাদ্রিদ ডানপন্থী ও রক্ষণশীল সরকারের প্রধানমন্ত্রী মারিয়ানো রাজয়ের নেতৃত্বে ফিলিস্তিনের পক্ষে ভোট দিয়েছিল।

সানচেজ স্পেনীয় উত্তরাধিকার সূত্রে ফিলিস্তিনিদের প্রতি এই সহানুভূতি প্রাপ্ত হয়েছেন। আর গাজায় চলমান এই আগ্রাসন তার অনুভূতিকে আরো তীক্ষ্ণ করে তুলেছে। মাদ্রিদের আলকানো রয়েল ইনস্টিটিউট পরিচালিত একটি সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, স্পেনের ৮২ শতাংশ মানুষ মনে করে যে ইসরাইল গাজায় জাতিগত নির্মূল অভিযান পরিচালনা করছে। এর মধ্যে বামপন্থীদের ৯৭ শতাংশ, মধ্যমপন্থীদের ৮৫ শতাংশ ও ডানপন্থীদের ৬২ শতাংশ এই বিশ্বাস লালন করেন। অর্থাৎ বলা যায় স্পেনে ইসরাইল ও তার কর্মকাণ্ডকে প্রত্যাখ্যান করার উপর এক ধরনের ঐক্য হয়ে গেছে।

অর্থাৎ এখন সানচেজ যা করছে, তা মূলত তার দেশের ক্রমবর্ধমান মতামতেরই প্রতিনিধিত্ব করছেন। এদিকে, পশ্চিমাবিশ্বের অনেক রাজনীতিবিদই নিজ দেশের জনসাধারণের এই অনুভূতির প্রতি লক্ষ্য রাখছেন না।

পিউ সেন্টার ২৪টি দেশে একটি জরিপে চালিয়েছে; যার মধ্যে স্পেন, অস্ট্রেলিয়া, গ্রীস, ইন্দোনেশিয়া, জাপান, নেদারল্যান্ডস, সুইডেন ও তুরস্ক রয়েছেন। এসব দেশের অন্তত ২০টি দেশে দেখা গেছে যে দেশের অন্তত অর্ধেক মানুষ নেতানিয়াহু ও তার দেশ ইসরাইলের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন।

সুতরাং সানচেজ গাজাকে গণহত্যার শিকার বলে বিশ্বাস করেন বলে এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। বরং এটি তার একটি পদক্ষেপ মাত্র। তিনিও আরো বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। যার মধ্যে রয়েছে ২০২৪ সালের মে মাসে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের স্বীকৃতি প্রদান, ইউরোপীয় ইউনিয়নকে ইসরাইলের সাথে বাণিজ্য চুক্তি স্থগিত করার প্রস্তাব, দক্ষিণ আফ্রিকা ইসরাইলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে যে মামলায় লড়ছে, ইউরোপকেও তাতে যুক্ত হওয়ার আহ্বান ইত্যাদি। একইসাথে ফিলিস্তিনি বিচার বিভাগ ঘোষণা করেছে যে তারা গাজায় মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ে একটি তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করবে। পরে সেটি তারা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতকে সরবরাহ করবে। যেন সেখানে ইসরাইলের যথাযথ বিচার হয় এবং ফিলিস্তিনিরা সঠিক বিচার পায়।

সূত্র : আল জাজিরা