চীনা অর্থায়নে জার্নাল প্রকাশ বন্ধ করল অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি

ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ নিয়ে নৈতিক উদ্বেগ থাকায় ওইউপি ২০২৩ সাল থেকে এফএসআরে প্রকাশিত দুটি গবেষণাপত্র প্রত্যাহার করে।

নয়া দিগন্ত অনলাইন
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ছাত্রীদের মানববন্ধন
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ছাত্রীদের মানববন্ধন |ইউএনবি

চীনের বিচার মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে প্রকাশিত একটি বিতর্কিত অ্যাকাডেমিক জার্নাল প্রকাশ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস (ওইউপি)। দীর্ঘদিন ধরে প্রকাশনায় থাকা কিছু প্রবন্ধে ডিএনএ সংগ্রহসংক্রান্ত নৈতিক মানদণ্ড নিয়ে উদ্বেগ থাকায় এ সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফরেনসিক সায়েন্স রিসার্চ (এফএসআর)-এর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, চলতি বছরের শেষ নাগাদ জার্নালটির প্রকাশনা বন্ধ করবে ওইউপি।

বিবৃতিতে আরো বলা হয়, ২০২৫ সালের পর থেকে এফএসআরের কোনো গবেষণাপত্র প্রকাশ করবে না ওইউপি। প্রকাশিত সর্বশেষ সংখ্যাটি হবে ভলিউম ১০, ইস্যু ৪।

এফএসআর হচ্ছে চীনের অ্যাকাডেমি অব ফরেনসিক সায়েন্সের একটি জার্নাল, যা দেশটির বিচার মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হয়। ফরেনসিক মেডিসিন বিষয়ে এটি চীনের একমাত্র ইংরেজি ত্রৈমাসিক জার্নাল হিসেবে পরিচিত। ওইউপি ২০২৩ সাল থেকে এটি প্রকাশ করে আসছে।

এফএসআরে প্রকাশিত বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ এরই মধ্যে সমালোচনার মুখে পড়েছে। চীনে নজরদারির আওতায় থাকা উইঘুর ও অন্যান্য জাতিগত সংখ্যালঘুদের জেনেটিক তথ্য নিয়ে গবেষণার অভিযোগে এসব প্রবন্ধ নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়।

সমালোচকদের ভাষ্য, এসব গবেষণায় অংশ নেয়া ব্যক্তিরা হয়তো তাদের ডিএনএ নমুনা গবেষণায় ব্যবহারের জন্য স্বেচ্ছায় সম্মতি দেননি। তাছাড়া, এসব কর্মকাণ্ড সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর ওপর নজরদারি আরো বাড়াতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হয়।

২০২০ সালে চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের উরুমচিতে বসবাসরত ২৬৪ জন উইঘুরের রক্তের নমুনা নিয়ে একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়। গবেষণাপত্রে দাবি করা হয়, সংশ্লিষ্টদের সম্মতিতেই নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল এবং নমুনাদাতাদের পরিচয় গোপন রাখা হয়েছিল।

তবে সেই গবেষণার প্রধান লেখকের সাথে চীনের নিরাপত্তা সংস্থার সম্পৃক্ততা ছিল এবং তিনি জিনজিয়াং পুলিশ কলেজ থেকে গবেষণা অনুদান পেয়েছিলেন।

২০২৪ সালে এক্সপ্রেশন অব কনসার্ন (উদ্বেগ প্রকাশ) শিরোনামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করে ওইউপি, যেখানে প্রশ্ন তোলা হয়, জিনজিয়াংয়ের উইঘুররা আদৌ কোনো গবেষণায় অংশগ্রহণে অস্বীকৃতি জানানোর স্বাধীনতা পান কিনা। তবে এখন পর্যন্ত ওই গবেষণাপত্রটি প্রত্যাহার করা হয়নি।

ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ নিয়ে নৈতিক উদ্বেগ থাকায় ওইউপি ২০২৩ সাল থেকে এফএসআরে প্রকাশিত দুটি গবেষণাপত্র প্রত্যাহার করে। এ গবেষণাগুলোর সাথেও চীনা পুলিশ কর্তৃপক্ষের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে জানা গেছে।

ফরেনসিক বিজ্ঞান গবেষণা সাধারণত পুলিশ কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। তবে চীনে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সংস্থাগুলো কোনো ভারসাম্যমূলক নিয়ন্ত্রণের আওতায় না থাকায়, এসব গবেষণা আন্তর্জাতিক নৈতিক মানদণ্ড পূরণ করে কিনা, তা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে।

প্রসঙ্গত, উইঘুররা দীর্ঘদিন ধরে চীনা কর্তৃপক্ষের কঠোর নজরদারির মধ্যে রয়েছে। ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে প্রায় ১০ লাখ উইঘুরকে তথাকথিত ‘কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে’ আটকে রাখার অভিযোগ রয়েছে।

জিনজিয়াংয়ে চীন সরকারের এসব পদক্ষেপ মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে বলে সতর্ক করেছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা। বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য পরীক্ষার আড়ালে উইঘুরদের ডিএনএ সংগ্রহ করা হয়েছে, যাতে ভবিষ্যতে তাদের ওপর নজরদারি আরো জোরদার করা যায়।

এফএসআর-এর সাথে ওইউপির সংশ্লিষ্টতা ও ডিএনএ সংগ্রহের নৈতিকতা নিয়ে প্রথম প্রশ্ন তোলেন বেলজিয়ামের ইউনিভার্সিটি অব লুভেনের প্রকৌশল অধ্যাপক ইভ মোরো। তিনি বলেন, ‘ওইউপির পদক্ষেপের জন্য আমি কৃতজ্ঞ, তবে তারা গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয় উপেক্ষা করেছে।’

তবে এফএসআর-এর সাথে সম্পর্ক নিয়ে বিস্তারিত মন্তব্য করতে রাজি হয়নি ওইউপি।

গত কয়েক বছরে চীনের জেনেটিক গবেষণা সংক্রান্ত প্রবন্ধের নৈতিকতা নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যালোচনা বেড়েছে। মানবাধিকার ইস্যুতে উদ্বেগের কারণে একটি শীর্ষস্থানীয় বৈজ্ঞানিক প্রকাশনা সংস্থা গত বছর চীনের ১৮টি গবেষণাপত্র প্রত্যাহার করে নেয়।

মোরো বলেন, ‘ফরেনসিক জেনেটিক্স এমন একটি ক্ষেত্র যেখানে বিশেষ সতর্কতা প্রয়োজন, কারণ এ গবেষণাই পুলিশি ডিএনএ শনাক্তকরণ ও ডেটাবেইসকে শক্তি জোগায়।’

তার মতে, ডিএনএ শনাক্তকরণ অপরাধ সমাধানে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি হলেও এটি গোপনীয়তা ও নৈতিকতার প্রশ্নও তোলে। মোরো আরও বলেন, ‘জিনজিয়াং ও তিব্বতে সংখ্যালঘুদের ওপর ব্যাপক নজরদারি থাকার কারণে, চীনে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী নৈতিক গবেষণা ও মানবাধিকারের প্রয়োগ নিশ্চিত করা অত্যন্ত কঠিন।’