ইসরাইল ও ইরানের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর আশঙ্কা জন্মেছিল, ইরান হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দিতে পারে। বিশ্বজুড়ে তেল সরবরাহের জন্য এই প্রণালী কৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ হরমুজ প্রণালী দিয়ে পৃথিবীর প্রায় এক-পঞ্চমাংশ অপরিশোধিত তেল পারাপার হয়।
ইরানের নৌবাহিনীর কমান্ডারের মতে, ইরান এই প্রণালী বন্ধ করার কথা বিবেচনা করতে পারে।
যুক্তরাজ্যের গোয়েন্দা সংস্থা এমআইসিক্সের সাবেক প্রধান স্যার অ্যালেক্স ইয়োঙ্গার বিবিসিকে বলেছেন, সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির ক্ষেত্রে যা হতে পারে তা হলো ওই চ্যানেল অবরোধ করা।
তার কথায়, ‘প্রণালী বন্ধ করা স্পষ্টতই একটা অবিশ্বাস্য অর্থনৈতিক সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। কারণ এর প্রভাব পড়বে তেলের দামের ওপর।’
হরমুজ প্রণালী দিয়ে কী পরিমাণ তেল যায়?
যুক্তরাষ্ট্রের এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (ইআইএ) অনুমান, ২০২৩ সালের প্রথমার্ধে প্রতিদিন প্রায় দুই কোটি ব্যারেল তেল এই প্রণালী দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। প্রতি বছর সমুদ্রপথে পরিবহন করা প্রায় ৬০ হাজার কোটি ডলার মূল্যের জ্বালানি বাণিজ্যের সমতুল্য এটি।
হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেয়া হলে বিশ্বব্যাপী তেল সরবরাহে উল্লেখযোগ্যভাবে দেরি হতে পারে এবং এর তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়বে তেলের দামের ওপর। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য যেসব দেশ উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে তেল আমদানির ওপর নির্ভরশীল, তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
তবে বিশ্লেষকরা সতর্ক করে দিয়েছেন, হরমুজ প্রণালী বন্ধ করা হলে ইসরাইল ও ইরানের মধ্যে সংঘাত আরো তীব্র হয়ে উঠতে পারে।
হরমুজ প্রণালীর বিস্তৃতি
হরমুজ প্রণালী ইরান ও ওমানের মধ্যে অবস্থিত একটা চ্যানেল বা খাল। এর প্রবেশ ও প্রস্থানপথ প্রায় ৫০ কিলোমিটার প্রশস্ত। মধ্যবর্তী স্থানে এর সবচেয়ে সংকীর্ণ অংশ প্রায় ৪০ কিলোমিটার প্রশস্ত। তবে প্রণালীটির কেন্দ্রীয় অংশ বড় জাহাজের চলাচল করার জন্য যথেষ্ট গভীর।
সামুদ্রিক নেভিগেশন চার্টে একটা নিরাপদ ইনবাউন্ড লেন, একটা নিরাপদ আউটবাউন্ড লেন এবং এই দুইয়ের মাঝে একটা বাফার জোন নির্ধারণ করা হয়েছে- বিশেষত ভারী তেল ট্যাংকারগুলোর কথা মাথায় রেখে। ফলে বড় জাহাজগুলোকে মাত্র ১০ কিলোমিটার প্রশস্ত একটা চ্যানেল ধরে চলাচল করতে হয়। ট্যাংকারগুলো পারস্য উপসাগরে প্রবেশের সময় ইরান ও আরব দেশগুলোর মধ্যে বিতর্কিত অঞ্চল গ্রেটার ও লেসার তুন্ব দ্বীপপুঞ্জকে অতিক্রম করে।
বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করেন সমুদ্রে যান চলাচল ব্যাহত করার সবচেয়ে সম্ভাব্য পদ্ধতি সামরিক অভিযান, ঠিক যেমনটা ১৯৮০ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় ঘটেছিল।
প্রতিরক্ষামূলক মতবাদ?
বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, ইরানের কাছে হরমুজ প্রণালী বন্ধ করা অনেকটা পারমাণবিক অস্ত্র রাখার মতোই। একে প্রতিরোধ ক্ষমতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যেমন দীর্ঘদিন ধরে ইরানের সামরিক পারমাণবিক কর্মসূচির বিরোধিতা করে আসছে, তেমনই বৃহৎ শক্তিগুলো বারবার বলেছে, তারা তেহরানকে সে দেশের কৌশলগত ভৌগোলিক অবস্থান ব্যবহার করে বৈশ্বিক জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করতে দেবে না।
বিশেষজ্ঞরা প্রায়শই ভবিষ্যদ্বাণী করে থাকেন ইরান হয়তো সাময়িকভাবে এ প্রণালী বন্ধ করে দিতে পারবে। কিন্তু তাদের অনেকেই এই কথাও বিশ্বাস করেন, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা সামরিক উপায় ব্যবহার করে সামুদ্রিক যান চলাচল ব্যবস্থাকে দ্রুত পুনঃস্থাপন করতে পারবে।
ইরান কিভাবে হরমুজ প্রণালী বন্ধ করতে পারে?
মার্কিন কংগ্রেসনাল রিসার্চ সার্ভিসের ২০১২ সালের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল, ইরান তাদের উদ্দেশ্যে সফল হতে ধীরে ধীরে পদক্ষেপ নিতে পারে। সেই পদক্ষেপগুলোর তালিকায় রয়েছে- লঙ্ঘনের পরিণতি স্পষ্টভাবে উল্লেখ না করেই হরমুজ প্রণালীতে নৌযান চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণা করা, যাত্রীবাহী জাহাজ পরিদর্শন বা বাজেয়াপ্ত করা হতে পারে বলে ঘোষণা করা, সামরিক শক্তি ব্যবহার করে নির্দিষ্ট জাহাজকে লক্ষ্যবস্তু হিসেবে নিশানা করা, প্রণালী ও পারস্য উপসাগরে নেভাল মাইন স্থাপন করা এবং বাণিজ্যিক ও সামরিক জাহাজকে লক্ষ্যবস্তু হিসেবে নিশানা করতে সাবমেরিন ও ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা।
ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় ইরান তেল ট্যাংকারগুলোতে ‘সিল্কওয়ার্ম ক্ষেপণাস্ত্র’ মোতায়েন করার পাশাপাশি উপসাগরীয় জলসীমায় নেভাল মাইন স্থাপন করেছিল। এই মাইনগুলোর মধ্যে একটা ‘ইউএসএস স্যামুয়েল বি রবার্টসে’ আঘাত হানে। এরপর মার্কিন সামরিক বাহিনী প্রতিশোধ নিতে বাধ্য হয়।
ইরানের সামরিক ক্ষমতা
তেহরানে ইসরাইলি বিমান হামলায় নিহত হওয়ার দু’দিন আগে, ইরানের ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড কোরের (আইআরজিসি) সাবেক কমান্ডার মেজর জেনারেল হোসেইন সালামি হরমুজ প্রণালীতে অবস্থিত নেভাল ইউনিটগুলো পরিদর্শন করতে গিয়েছিলেন।
তিনি পারস্য উপসাগর ও এর আশপাশের অঞ্চলগুলোকে ইসলামি প্রজাতন্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষামূলক অঞ্চলগুলোর মধ্যে একটা হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। বিশেষত উচ্চগতির ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপকারী জাহাজগুলোর দিকে ইঙ্গিত করেছিলেন যে জাহাজগুলো তিন মিনিটেরও কম সময়ে ১০ কিলোমিটার ভ্রমণ করতে সক্ষম।
জেনারেল সালামি জানিয়েছিলেন, এই দ্রুত আক্রমণকারী জাহাজ, ভারী যুদ্ধজাহাজ ও ক্ষেপণাস্ত্রকে প্রতিরক্ষামূলক অভিযানের সময় ব্যবহার করা হবে। তিনি অ্যান্টি-শিপ নেভাল মাইনকে ‘নৌ যুদ্ধের সবচেয়ে নির্ণায়ক অস্ত্রগুলোর একটা’ হিসেবেও তুলে ধরেছিলেন।
তার কথায়, ‘পরিসর, ক্ষমতা ও অভিযানের বৈচিত্র্যের দিক থেকে’ নেভাল ড্রোনগুলোর বিস্তৃতি ঘটেছে।
বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন?
বিশেষজ্ঞরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, প্রতি মাসে পানিপথে চলাচলকারী প্রায় তিন হাজারের মতো জাহাজকে থামানোর জন্য ইরান যেসব উপায়ের সাহায্য নিতে পারে, তার মধ্যে সবচেয়ে কার্যকর উপায় ‘ফাস্ট অ্যাটাক বোট’ (দ্রুত আক্রমণকারী নৌযান) এবং সাবমেরিন ব্যবহার করে মাইন মোতায়েন করে রাখা।
ইরানের নৌবাহিনী ও ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড কোর নৌবাহিনী বিদেশী যুদ্ধজাহাজ ও বাণিজ্যিক জাহাজের ওপর আক্রমণ চালাতে পারে। তবে, বড় সামরিক জাহাজগুলো আবার ইসরাইলি বা মার্কিন বিমান হামলার সহজ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।
ইরানের দ্রুতগামী নৌকাগুলোতে প্রায়শই জাহাজ-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র থাকে। শুধু তাই নয়, ওই দেশ বিভিন্ন ধরনের সার্ফেস ভেসেল (যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে পানিপৃষ্ঠের উপরে ব্যবহার করা যায়) আধা-নিমজ্জনযোগ্য জাহাজ এবং সাবমেরিনও পরিচালনা করে।
বর্তমানে মেরিটাইম ট্র্যাকিং ওয়েবসাইটগুলো স্যাটেলাইট চিত্র ব্যবহার করে ইরানের দক্ষিণ সামুদ্রিক সীমান্তের কাছে ইরানি সামরিক জাহাজের গতিবিধির কথা জানিয়েছে।
প্রণালী বন্ধে কোন দেশগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে?
বিশ্লেষক সংস্থা ভোরটেক্সার গবেষণায় দেখা গেছে, সৌদি আরব হরমুজ প্রণালী দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৬০ লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল রফতানি করে, যা যেকোনো অন্য প্রতিবেশী দেশের তুলনায় বেশি। এই প্রণালী ব্যবহার করে অন্য যে দেশগুলো অপরিশোধিত তেল আমদানি করে তাদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় হলো চীন, ভারত, জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়া।
ইআইএর অনুমান ২০২২ সালে, হরমুজ প্রণালী দিয়ে যাওয়া প্রায় ৮২ শতাংশ অপরিশোধিত তেল এবং ঘনীভূত তেলই (কম ঘনত্বের তরল হাইড্রোকার্বন যা সাধারণত প্রাকৃতিক গ্যাসের সাথে তৈরি হয়) পাঠানো হতো এশিয়ার দেশগুলোতে।
চলতি বছরের ১৬ এপ্রিল ইরানের সরকারি বার্তাসংস্থা ইরনা দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইওলকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছিল, দক্ষিণ কোরিয়ায় সরবরাহ হওয়া তেলের ৬০ শতাংই হরমুজ প্রণালী দিয়ে যায়।
ইআইএ জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র প্রতিদিন এই প্রণালী ব্যবহার করে প্রায় সাত লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল এবং ঘনীভূত তেল আমদানি করে, যা তাদের মোট তেল আমদানির প্রায় ১১ শতাংশ এবং পেট্রোল ব্যবহারের তিন শতাংশ। হরমুজ প্রণালী ব্যবহার করে প্রতিদিন ইউরোপের সামগ্রিক তেলের ১০ লাখ ব্যারেলের কম বলে মনে হচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে আরব ও এশীয় দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় শক্তির চেয়ে বেশি পরিমাণে ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
এদিকে সাম্প্রতিক সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় শক্তি ইসরাইলের সাথে রাজনৈতিকভাবে জোটবদ্ধ হয়েছে। অন্যদিকে, বেশ কয়েকটা এশীয় দেশের সাথে ইরানের ভালো বা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।
চীনের প্রভাব
হরমুজ প্রণালী দিয়ে নিয়ে যাওয়া তেলের অন্যতম বৃহৎ গ্রাহক চীন। এই তেলের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ইরান কিন্তু বিশ্ব বাজারের দামের চেয়ে কম দামে বিক্রি করে। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক জীবনরেখা বলে মনে করা হয়, যা তেহরানের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞাকে মোকাবেলা করতে সাহায্য করে।
ইরানের তেলের প্রধান ভোক্তা হিসেবে বেইজিং কোনোভাবেই তেলের দাম বৃদ্ধি বা জাহাজ চলাচলের পথে কোনোরকম বাধাকে মানবে না বলেই মনে করা হচ্ছে। এই গুরুত্বপূর্ণ এনার্জি করিডোর বন্ধ হওয়া আটকাতে চীন তার পূর্ণ কূটনৈতিক শক্তি ব্যবহার করবে বলে আশা করা যেতে পারে।
জ্বালানি পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান আউটলুক অ্যাডভাইজার্সের অংশীদার আনাস আলহাজ্জি সিএনবিসিকে বলেন, হরমুজ প্রণালী বন্ধ করলে সম্ভবত ইরানের শত্রুদের চেয়ে তার মিত্রদেরই বেশি ক্ষতি হবে।
‘তারা (ইরানিরা) এমন কিছু করতে চাইবে না যাতে প্রথমে নিজেদেরই ক্ষতি হয়,’ বলেন তিনি।
বিকল্প রুট রয়েছে?
বছরের পর বছর ধরে ক্রমাগত হরমুজ প্রণালী বন্ধ করার হুমকির কারণে উপসাগরীয় অঞ্চলের তেল রফতানিকারক দেশগুলোকে একটা বিকল্প রুট তৈরি করতে উৎসাহ দিয়েছে।
ইআইএ-এর প্রতিবেদন অনুসারে, সৌদি আরব তার পূর্ব-পশ্চিম পাইপলাইন সক্রিয় করেছে। এই পাইপলাইন এক হাজার ২০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং প্রতিদিন ৫০ লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল পরিবহন করতে পারে। ২০১৯ সালে, সৌদি আরব সাময়িকভাবে অপরিশোধিত তেল পরিবহনের জন্য একটা প্রাকৃতিক গ্যাস পাইপলাইন পুনর্নির্মাণ করে।
সংযুক্ত আরব আমিরাত তার অভ্যন্তরীণ অয়েল ফিল্ডগুলোকে ওমান উপসাগরের ফুজাইরাহ বন্দরের সাথে জুড়েছে। দৈনিক ১৫ লাখ ব্যারেল তেল এই পাইপলাইনের মাধ্যমে যেতে পারে।
২০২১ সালের জুলাই মাসে, ইরান ওমান উপসাগরে অপরিশোধিত তেল পরিবহনের উদ্দেশ্যে গোরেহ-জাস্ক পাইপলাইন উদ্বোধন করে। এই পাইপলাইন দিয়ে বর্তমানে প্রতিদিন প্রায় তিন লাখ ৫০ হাজার ব্যারেল তেল পরিবহন করতে পারে, যদিও প্রতিবেদন অনুসারে ইরান এখনো এই পাইপলাইন চালু করেনি।
ইআইএ-এর অনুমান অনুযায়ী এই বিকল্প রুটগুলো সম্মিলিতভাবে প্রতিদিন প্রায় ৩৫ লাখ ব্যারেল তেল পরিচালনা করতে পারে। এই সংখ্যাটা বর্তমানে হরমুজ প্রণালী দিয়ে যাওয়া অপরিশোধিত তেলের প্রায় ১৫ শতাংশ।
সূত্র : বিবিসি