তুরস্কের সাথে এবার যুদ্ধে জড়াবে ইসরাইল?

সিরিয়ায় তুর্কি সামরিক ঘাঁটি, তুর্কি সামরিক সহায়তা, এমনকি প্রশিক্ষণ কার্যক্রমকেও তারা তাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে দেখে। সে কারণে তারা এখন সিরিয়ায় তুর্কি সামরিক উপস্থিতি রোধে যেকোনো পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত।

আবু সাঈদ
এরদোগান-নেতানিয়াহু
এরদোগান-নেতানিয়াহু |আল জাজিরা

সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ইসরাইলি কর্মকর্তাদের বক্তব্য এবং সিরিয়ার ভূখণ্ডে তাদের ধারাবাহিক হামলা দেখে স্পষ্ট যে তারা এখন তুরস্ককেও লক্ষ্যবস্তু হিসেবে বিবেচনা করছে।

তুরস্ক ও সিরিয়ার মধ্যে সম্পাদিত প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তিগুলোকে সরাসরি হুমকি হিসেবে দেখছে ইসরাইল। সিরিয়ায় সম্ভাব্য তুর্কি সামরিক ঘাঁটিতে হামলার বিষয়টিকে তারা শত্রুতার স্পষ্ট পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করছে।

তুরস্কের প্রতিক্রিয়ার প্রকৃতি নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও দেশের রাজনৈতিক ও সামরিক মহলে ব্যাপক উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

ইসরাইলের উদ্দেশ্য কী?

গাজা যুদ্ধ শুরুর পর থেকে স্পষ্ট হয়েছে, ইসরাইল আর ‘রাজনৈতিক বাস্তববাদ‘ নয়, বরং ‘রাজনৈতিক ধর্মতত্ত্ব‘ অনুসারে কাজ করছে।

এর অর্থ, তারা ‘বৃহত্তর ইসরাইল‘ প্রতিষ্ঠার এবং ‘প্রতিশ্রুত ভূমির‘ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দিকে এগোচ্ছে। এই লক্ষ্যে তারা যুক্তরাষ্ট্রের কিছু প্রভাবশালী গোষ্ঠীর সাথে সমঝোতায় পৌঁছেছে।

এই ধর্মতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে ইসরাইল প্রতিবেশী দেশগুলোর ভূখণ্ড দখল করে সীমানা প্রসারিত করেছে। তারা গাজার অংশ, পশ্চিমতীর এবং দক্ষিণ লেবাননের কিছু এলাকা দখল করেছে। সিরিয়ার বিপ্লবের পর থেকে তারা সিরিয়ায় তাদের দখলদারিত্ব বাড়িয়েছে এবং এখানেই থেমে থাকতে চায় না।

তারা জর্ডান, মিসর ও সৌদি আরবকেও হুমকি দিয়েছে। এসব দেশে ফিলিস্তিনিদের পুনর্বাসনের একটি পরিকল্পনা চাপিয়ে দিতে চাচ্ছে। এই সম্প্রসারণবাদী প্রকল্পের মূল তত্ত্ব হচ্ছে ‘অস্থির প্রতিবেশী‘।

ইসরাইল চায় না তার চারপাশে কোনো শক্তিশালী, স্থিতিশীল বা অর্থনৈতিকভাবে টেকসই রাষ্ট্র গড়ে উঠুক। তারা ধারাবাহিকভাবে সিরিয়ার সামরিক অবকাঠামো ধ্বংস করছে এবং পুনর্গঠনের অনুমতি দিচ্ছে না।

সিরিয়ায় তুর্কি সামরিক ঘাঁটি, তুর্কি সামরিক সহায়তা, এমনকি প্রশিক্ষণ কার্যক্রমকেও তারা তাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে দেখে। সে কারণে তারা এখন সিরিয়ায় তুর্কি সামরিক উপস্থিতি রোধে যেকোনো পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত।

কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া ও ওয়াশিংটনের উপর চাপ

তুরস্ক ইসরাইলের সাম্প্রতিক তৎপরতাকে সরাসরি আক্রমণ হিসেবে দেখছে। আঙ্কারা কিছুটা উত্তেজনা প্রশমনের আশা করলেও টি৪ সামরিক ঘাঁটিতে ইসরাইলি হামলা এবং তীব্র ভাষার বিবৃতিগুলো প্রত্যাশিত ছিল না। এতে তুরস্কে রাজনৈতিক মহল ও জনগণের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।

প্রথম প্রতিক্রিয়ায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদান রয়টার্সকে বলেন, ‘ইসরাইলের আচরণ কেবল সিরিয়াকেই নয়, পুরো অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করছে।‘

যুক্তরাষ্ট্রে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর সাথে বৈঠকে তিনি সিরিয়ায় ইসরাইলের আক্রমণাত্মক নীতি তুলে ধরেন এবং তুরস্কের অসন্তোষ প্রকাশ করেন।

আঙ্কারা বোঝে, সিরিয়ার ভঙ্গুর পরিস্থিতিতে ইসরাইলের সাথে সরাসরি সংঘর্ষ সিরিয়াকে আরো বিপর্যস্ত করবে। সামরিক বিকল্প ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ এতে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধক্ষেত্রে জড়িয়ে পড়তে পারে এবং বৃহৎ সঙ্ঘাতের আশঙ্কা দেখা দেয়, যা তুরস্ক এড়িয়ে চলতে চায়। তাই তারা কূটনৈতিক পথ ও ওয়াশিংটনের উপর চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে সমাধান খুঁজছে।

যদিও ট্রাম্প প্রশাসনের সাথে তুরস্কের সম্পর্ক ভালো, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণে ওয়াশিংটনের ভবিষ্যৎ অবস্থান অনিশ্চিত।

ইসরাইল শক্তির অবস্থানে নেই

ইসরাইল বাস্তবে মার্কিন সমর্থন ছাড়া যেকোনো কিছুই করতে অক্ষম। তুরস্কের সামরিক সক্ষমতা আকার ও সরঞ্জামের দিক থেকে ইসরাইলের চেয়ে স্পষ্টভাবে এগিয়ে।

ইসরাইলের আগ্রাসী নীতি—যুদ্ধ, দখল ও সামরিক অভিযান—তার অর্থনীতিতে বিপুল চাপ ফেলেছে। মাত্র এক বছরে দেশটির অর্থনীতি ২৫ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে এবং চলমান যুদ্ধের ব্যয় ৪০০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে।

ইসরাইল ২০২৪ সালে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলারের মার্কিন অস্ত্র সহায়তা পেয়েছে, যদিও প্রকৃত অঙ্ক গোপন চ্যানেলের কারণে জানা যায় না।

বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দার প্রেক্ষাপটে ইসরাইলের পক্ষে এই ব্যয়বহুল যুদ্ধ দীর্ঘদিন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রই যুদ্ধ থামাতে চাপ দেবে। এছাড়া জনসংখ্যা ও সামরিক জনবলের ঘাটতিতে ইসরাইল একসাথে চারটি ফ্রন্টে যুদ্ধ চালাতে পারবে না। তার বাহিনীর অভ্যন্তরীণ সমন্বয়ও ধরে রাখতে পারবে না।

যদিও নেতানিয়াহু ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মতবিরোধ প্রকাশ্য নয়, কিন্তু সেটা বিদ্যমান এবং বাড়ছে। অর্থনৈতিক সঙ্কট ও জনদুর্ভোগের ফলে শুরু হওয়া জনবিক্ষোভ তীব্রতর হবে এবং একসময় নেতানিয়াহু ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হবেন।

ইউরোপ নিজেকে ইসরাইল থেকে দূরে সরাচ্ছে

ইউরোপ বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একটি উত্তপ্ত বাণিজ্য বিরোধে জড়িয়েছে এবং সিরিয়া নীতির ক্ষেত্রে তারা এখন ইসরাইলের পরিবর্তে তুরস্কের অবস্থানকে সমর্থন করছে। তাদের সাম্প্রতিক বিবৃতিগুলোতে এর ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ইউরোপীয়দের অসন্তোষ যত বাড়ছে, সেই ক্ষোভ ইসরায়েলের বিরুদ্ধেও আরো দৃঢ় অবস্থানে পরিণত হচ্ছে। ওয়াশিংটনের অর্থনৈতিক সঙ্কটের প্রতিক্রিয়ায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন আক্রমণাত্মক ইসরাইলি নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে পারে।

সিরিয়ায় ফ্রান্স ও তুরস্কের মধ্যে সহযোগিতা স্পষ্ট। স্পেন, ইতালি এবং ব্রিটেনও একই ধরনের অবস্থান নিতে পারে। সুতরাং অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং ক্রমশ অবনতিশীল সম্পর্ক ইউরোপকে এমন নীতি গ্রহণে বাধ্য করছে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের নীতির সাথে সাংঘর্ষিক।

নেতানিয়াহু ট্রাম্পের কাছ থেকে প্রত্যাশিত সাড়া পাননি

মধ্যপ্রাচ্যে, বিশেষ করে ইসরাইল ও তুরস্কে সিরিয়া ইস্যু সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পেলেও যুক্তরাষ্ট্রে এটি ততটা গুরুত্ব পায় না। ট্রাম্পের নীতির তালিকায় এখনো এটি অগ্রভাগে নেই।

এই প্রেক্ষাপটে নেতানিয়াহু সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন, সিরিয়া প্রসঙ্গটি ট্রাম্পের সামনে উপস্থাপন করেন এবং তুর্কি প্রভাব ঠেকাতে সমর্থন চান।

কিন্তু পরিস্থিতি তার প্রত্যাশা অনুযায়ী এগোয়নি। ট্রাম্প তার সাথে শীতল ও সংযত আচরণ করেন। যখন নেতানিয়াহু সিরিয়ায় ইসরাইলের নিরাপত্তার পক্ষে একটি বিবৃতি চান, ট্রাম্পের প্রতিক্রিয়া ছিল হতাশাজনক।

তিনি বলেন, ‘আমার একজন ভালো বন্ধু আছে এরদোগান। আমি তাকে পছন্দ করি। তিনিও আমাকে পছন্দ করেন। আমাদের মধ্যে কখনো কোনো সমস্যা হয়নি। আমরা একসাথে অনেক কিছু অতিক্রম করেছি। নেতানিয়াহু যদি তুরস্কের সাথে আপনার কোনো সমস্যা থাকে, আমি মনে করি আমি তা সমাধান করতে পারব। আমি আশা করি সমস্যা হবে না... তবে আপনাকে যুক্তিসঙ্গত হতে হবে।‘

ট্রাম্পের এই বক্তব্য নেতানিয়াহুকে বেশ বিরক্ত করে। তবে ‘যুক্তিসঙ্গত হওয়ার‘ এই সতর্কতা তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ ইসরাইল ও নেতানিয়াহুর লাগাতার দাবিতে ট্রাম্পের বিরক্তি বাড়ছে।

তুরস্ক সম্পৃক্ততার নিয়ম পুনর্লিখন করতে পারে

সিরিয়া কিংবা তুরস্কের বিরুদ্ধে ইসরাইলি আগ্রাসন রোধে শুধু অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক বা রাজনৈতিক পন্থা যথেষ্ট নাও হতে পারে। তাই আঙ্কারা সম্ভবত সীমান্তের বাইরের সামরিক উপস্থিতির ক্ষেত্রে সম্পৃক্ততার নিয়ম পুনর্বিন্যাস করবে।

যেমন, ইরাকে তুর্কি বাহিনী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর আক্রমণের শিকার হলে, তুরস্ক দ্রুত জবাব দেয়। কিন্তু যদি এই আক্রমণ কোনো রাষ্ট্র থেকে আসে? অর্থাৎ যদি ইসরাইল সিরিয়ার অভ্যন্তরে তুর্কি সামরিক স্থাপনাগুলোতে হামলা চালায়, তবে প্রতিক্রিয়া কী হবে? ন্যাটোর ভূমিকা কী হবে? তাদের অবস্থান কোথায় দাঁড়াবে?

এই প্রশ্নগুলো তুরস্ককে তার পদক্ষেপের নীতি পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করছে। বর্তমানে তুরস্কের সামরিক, কূটনৈতিক এবং রাজনৈতিক মহলে এই বিষয়ে তীব্র আলোচনা চলছে।

যদিও এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি, তবে এটা স্পষ্ট যে তুরস্ক এই পর্যায়ে পিছু হটতে প্রস্তুত নয়।

সূত্র : আল জাজিরা