ইরানের সংসদ স্পিকার মোহাম্মদ বাকের কালিবাফের গলায় ধ্বনিত হয়েছিল প্রতিশোধের প্রত্যয়। তিনি বললেন, “আমাদের মহান জাতি দেখেছে, শত্রুর প্রথম আক্রমণের পরই আমাদের সশস্ত্র বাহিনী দ্রুত মাঠের দখল নিয়ে নিয়েছে। আজ আমরা প্রমাণ করেছি, বহু বছর ধরে যার গর্ব করত তারা, সেই তথাকথিত ‘আয়রন ডোম’ আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনি।”
তিনি আরও বলেন, “হাইফা, তেলআবিব কিংবা অন্য যে কোনো জায়গা, আমরা যদি সিদ্ধান্ত নিই, দখলীকৃত ফিলিস্তিনের সেখানে আঘাত করবই। আমরা একযোগে লড়ছি, আমাদের জাতিগত, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিভাজন মুছে গেছে। এই ঐক্য, এই সংহতিই আমাদের আসল শক্তি।
জাতিসংঘের ভূমিকা নিয়েও তীব্র সমালোচনা ঝরেছে তার কণ্ঠে। যদি দখলদার ইহুদিবাদী বাহিনী একা পড়ে যেত, নিশ্চিন্তে বলা যায়, তারা টিকতেই পারত না। আমরা এখনও সংযম দেখাচ্ছি, কিন্তু ইহুদিবাদীরা যেন ভেবে না বসে আমরা পশ্চিমাদের মতো, যাদের হুমকি দিলে বশে আনা যায়।
১৩ জুন ২০২৫। কোনো পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই ইসরাইল ইরানের ওপর বোমাবর্ষণ শুরু করে। পরমাণু গবেষণা কেন্দ্র, সামরিক ঘাঁটি, এমনকি আবাসিক এলাকা পর্যন্ত বাদ যায়নি। নিহত হন ইরানের একাধিক সামরিক কমান্ডার, পরমাণু বিজ্ঞানী এবং নিরীহ নাগরিক। একে ইরান বলছে ‘অঘোষিত আগ্রাসন’, ‘অন্যায় যুদ্ধ’।
এর প্রতিক্রিয়ায় ইরান যেন গর্জে ওঠে। ইসলামি বিপ্লবী রক্ষী বাহিনী বা আইআরজিসি শুরু করে প্রতিশোধমূলক হামলার তরঙ্গ। ১৯ জুন পর্যন্ত তারা অন্তত ১৫ দফা হামলা চালিয়েছে ইসরাইলের ওপর, যার লক্ষ্য ছিল, সামরিক ঘাঁটি, অস্ত্র ডিপো, বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং যোগাযোগ অবকাঠামো
১৯ জুনের সেই সকাল। ইসরাইলের রামাত গান এলাকার জাবটিনস্কি স্ট্রিটে একটি সুউচ্চ ভবনের পাদদেশে আছড়ে পড়ে ইরানের একটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। জায়গাটি তেলআবিবের ডায়মন্ড এক্সচেঞ্জ জোন থেকে মাত্র ২০০ মিটার দূরে।
চোখের সামনে বিস্ফোরণটা ঘটতে দেখে এক প্রত্যক্ষদর্শী ৬৯ বছর বয়সী আশের আদিভ বলেন, পুরো ব্যাপারটা ছিল একটা অ্যাটম বোমা ফাটার মতো। যেন ভূমিকম্প। আশেরের মা ছিলেন ইরানি ইহুদি, জন্ম ইসফাহানে। তিনি ফারসি ভাষায় বড় হয়েছেন। তাঁর মনে এখনও ফারসি ভাষা রয়ে গেছে।
তাঁর স্ত্রী আন্নি, মরোক্কো থেকে ইসরাইলে এসে ১৯৬৯ সাল থেকে বসবাস করছেন। তেল আবিবের ব্যর্থতা ধরতে পেরেছেন তিনি। তাঁর আবেদন আরও সরাসরি: ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বলুন আমাদের পাশে দাঁড়াতে।
তেল আবিবের যেখানে আঘাত লেগেছে, সেখানে এক ছোট পিৎজা দোকান সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। পাশের অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকগুলোতেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। জানালার কাচ ছিটকে পড়েছে রাস্তায়, গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে, লোকজন আগেভাগে সাইরেন শুনে আশ্রয় কেন্দ্রে ঢুকে যাওয়ায় বড় ধরণের হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।
তবুও আতঙ্ক ছিল সর্বত্র।
এই যুদ্ধ আর কূটনীতির খেলায় এখন বাঘে-গরুতে এক ঘাটে পানি খাচ্ছে না। দুই পক্ষই জানে— এই সংঘাত কেবল তাদের দুজনের নয়, গোটা অঞ্চলকে গ্রাস করতে পারে। তেহরানের বক্তব্য অনুযায়ী, ইরান কখনও ‘আরোপিত যুদ্ধ’ কিংবা ‘আরোপিত শান্তি’ মেনে নেয়নি, এবারও নেবে না।
তেলআবিব কেঁপে উঠেছে। পশ্চিম তীরের আকাশে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের ধোঁয়ার রেখা দেখা যাচ্ছে। এই সংকট শুধু অস্ত্রের নয়, শুধু রাজনীতিরও নয়— এ যেন আত্মপরিচয়ের প্রশ্ন, জাতীয় মর্যাদার প্রশ্ন।
একদিকে ইরানের নেতাদের কণ্ঠে জয়োল্লাস— “আমরা দেখিয়ে দিয়েছি, যেখানে চাই, সেখানে আঘাত হানতে পারি।” অন্যদিকে তেলআবিবের বিধ্বস্ত রাস্তায় দাঁড়িয়ে এক ইরানি-ইহুদি আশেরের মুখে দীর্ঘশ্বাস। সে জানে এ হামলা শুরু করেছে ইসরাইল। বিনা উস্কানিতে। এখন তাকে মুখবন্ধ করে থাকতে হচ্ছে। সত্য বলতে পারছে না। ইসরাইল যে যুদ্ধ শুরু হয়েছে, তা আর কেবল ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে শেষ হবে না। এটি এখন আত্মা আর অস্তিত্বের লড়াই। সূত্র: তাসনিম নিউজ, ফার্স্টপোস্ট, এএফপি।