নেতানিয়াহু কেন গাজা যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে বাধ্য হলেন?

বিশ্বব্যাপী ঘৃণার ঢেউ এবং আন্তর্জাতিক গ্রেফতারের হুমকির মুখে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গাজায় যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন।

নয়া দিগন্ত অনলাইন
বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু
বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু |সংগৃহীত

বিশ্বব্যাপী ঘৃণার ঢেউ এবং আন্তর্জাতিক গ্রেফতারের হুমকির মুখে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গাজায় যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন।

আল-জাজিরা নেট মাহমুদ সুলতানের লেখা একটি বিশ্লেষণাত্মক নিবন্ধ প্রকাশ করেছে। যেখানে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে গাজা যুদ্ধের অবসানে সম্মত হতে বাধ্য হওয়ার কারণগুলো ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

আল আলম নেটওয়ার্কের উদ্ধৃতি দিয়ে বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, নেতানিয়াহুকে যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে বাধ্য করার একটি কারণ ছিল তিনি জাতিসঙ্ঘে নিজেকে একা এবং বিশ্ব কর্তৃক ঘৃণার পাত্র হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত কর্তৃক জারি করা তার গ্রেফতারি পরোয়ানা কার্যকর হওয়ার ভয়ে নেতানিয়াহু ইউরোপীয় আকাশে উড়তেও অস্বীকৃতি জানান। নেতানিয়াহু যখন জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে ভাষণ দিতে যান, তখন উপস্থিত প্রতিনিধিদল হল ছেড়ে চলে যান এবং তিনি নিজেকে বিশ্ব নেতাদের শূন্য কক্ষে দেখতে পান।

ইউরোপীয় ব্যক্তিত্বরা প্রকাশ্যে ইহুদিবাদী শাসনব্যবস্থাকে গণহত্যার জন্য অভিযুক্ত করেছেন এবং শাসক গোষ্ঠীর ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞার দাবি বেড়েছে; এমনকি তেল আবিবপন্থী আমেরিকান ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে যেমন সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভানও।

এই বছরের আগস্টে (২০২৫) ২৮টি পশ্চিমা দেশ তেল আবিবের প্রতি গাজায় অপরাধ বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছিল। এই দাবিগুলো বিভিন্ন দেশ এবং প্রতিষ্ঠানের হুমকির পাশাপাশি ইহুদিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক, শিক্ষাগত এবং ক্রীড়া নিষেধাজ্ঞা আরোপেরও ছিল। নিষেধাজ্ঞার কারণে ইসরাইলি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিমরোদ গর্ন স্বীকার করেছিলেন যে গাজার কারণে বেশিরভাগ ইসরাইলি মনে করেন, বিশ্ব তাদের বিরুদ্ধে। এর ফলে ইসরাইলি সাবেক প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্ট স্বীকার করেছিলেন যে ‘আমরা একটি ঘৃণ্য রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছি।’

নেতানিয়াহুর আরেকটি ভুল, যা তাকে একঘরে করে ফেলেছিল এবং তাকে যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে বাধ্য করেছিল তা হলো এই ধারণা যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাকে কিছু করতে বাধ্য করবেন না এবং তাকে সমর্থন করবেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পর নেতানিয়াহু নিজেকে ট্রাম্পের তীব্র চাপের মধ্যে দেখতে পান। বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কে ইহুদিবাদী সরকারের উদ্বেগ এতটাই বেড়ে যায় যে নেতানিয়াহু সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে বিচ্ছিন্নতা মোকাবেলা করার জন্য তেল আবিবকে অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে।

পিউ রিসার্চ সেন্টারের সর্বশেষ জরিপে দেখা গেছে, ৫৮ শতাংশ ইসরাইলি বিশ্বাস করেন যে এই শাসক গোষ্ঠী অন্যান্য দেশের মধ্যে শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলেছে। জরিপে আরো দেখা গেছে, অধিকৃত অঞ্চলের বেশিরভাগই যুদ্ধের অবসান চায়। কারণ যুদ্ধ শাসকগোষ্ঠীর ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে এবং তাদের বিচ্ছিন্নতা বাড়িয়েছে।

এছাড়া ইহুদিবাদী শাসক গোষ্ঠী আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজেকে বিচ্ছিন্ন বলে মনে করেছে। কারণ, ট্রাম্প তেল আবিবকে না জানিয়ে হামাসের সাথে আলোচনা করেছেন, সিরিয়ার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছেন এবং ইরানের সাথে আলোচনায় আগ্রহী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।

অন্যদিকে, কাতারে হামাস নেতাদের হত্যার জন্য ইসরাইলি সরকারের প্রচেষ্টার ফলে ট্রাম্প দল ওয়াশিংটন এবং ন্যাটোর বাইরে তার মিত্রদের মধ্যে ঝামেলা তৈরি করার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ করেছে। এরপরে, ট্রাম্প নেতানিয়াহুর প্রতি হতাশা ঘোষণা করেছেন এবং সতর্ক করেছেন যে যুদ্ধ অবশ্যই শেষ করতে হবে।

এছাড়া গাজা যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য নেতানিয়াহুর চুক্তির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল ইহুদিবাদী সরকারের প্রতি ঘৃণা বৃদ্ধি এবং ইউরোপে ইসরাইল-বিরোধী বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হওয়া; একটি চ্যালেঞ্জ যা ইউরোপ এবং ইহুদিবাদী সরকারের মধ্যে ঐতিহাসিক সম্পর্কের সবচেয়ে বিপজ্জনক মোড় হিসেবে বিবেচিত হয়। এমন একটি সমস্যা যার কারণে তেল আবিব নিজেকে পতন এবং পতনের দ্বারপ্রান্তে দেখতে পেয়েছে।

ইসরাইলের বিরুদ্ধে ঘৃণা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে প্রথমবারের মতো তার সকল মিত্র দেশ তাকে ত্যাগ করার হুমকি দিয়েছে। এটি এমন দেশগুলোতে ঘটেছে, যেগুলো আগে কোনো ঘৃণা প্রকাশ থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত ছিল। শার্ম আল-শেখ চুক্তির চার দিন আগে, ইউরোপজুড়ে লাখ লাখ মানুষ ইসরাইলের বিরুদ্ধে সমাবেশ করেছিল; এমন একটি ঘটনা যা ইহুদিবাদী মিডিয়া ইউরোপ এবং ইহুদিবাদী শাসনের মধ্যে ঐতিহাসিক সম্পর্কের সবচেয়ে বিপজ্জনক মোড় বলে মনে করেছিল।

অধিকন্তু ইসরাইল নিজেকে পতন এবং বিলুপ্তির পথে এগিয়ে চলেছে এবং সম্ভবত সত্তর বছরেরও বেশি সময় আগে যেখানে থেকে এসেছিল সেখানে ধীরে ধীরে সম্মিলিতভাবে ফিরে যেতে হবে।

এই পরিস্থিতিতে সমগ্র বিশ্ব প্রথমবারের মতো যুদ্ধ বন্ধ করার প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে একমত হয়েছিল এবং নেতানিয়াহুর কাছে বিশ্ব জনমতের ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। তিনি তার কোনো লক্ষ্য অর্জন না করেই তার অহংকারের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। এখন তার ভাগ্য ও রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের জন্য অপেক্ষা করছে এমন একটি ভবিষ্যত, যা ক্ষমতা ছেড়ে ইসরাইলি কারাগারে বন্দী হয়ে জীবন কাটানোর হাতছানি দেয়।

সূত্র : পার্সটুডে