রাতের আকাশ হঠাৎ আগুনে জ্বলে উঠল। একটি আগুনের ফালা ছুটে চলেছে মহাশূন্য ফুঁড়ে, শব্দের চেয়ে পনেরো গুণ বেশি গতিতে। কেউ ভেবেছিল উল্কাপিণ্ড। কারও দাবি, গ্রহাণু। কেউ বলেছে,এ বুঝি কোনো গ্রহান্তরের আগন্তুক। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া সেই ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, ধূমায়িত শিখার রেখা টেনে হাইপারসনিক গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে একটি বস্তু। যারা দূর থেকে দৃশ্যটি দেখেছে, তারা কেউ কেউ চমকে উঠে বলেছে—“এটা বুঝি ড্রাগন উড়ছে আকাশে!” আর এই ড্রাগনের নাম,ফাত্তাহ। ইরান বলছে, এটাই তেহরানের তৈরি ‘ফাত্তাহ’ ক্ষেপণাস্ত্র। যার গতি ম্যাক ১৫। মানে শব্দের চেয়ে ১৫ গুণ বেশি।
ইরানের তৈরি ফাত্তাহ নামের এই হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র এখন সারা দুনিয়ার মিডিয়া, গবেষণাগার এবং প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া সেই জ্বলন্ত অগ্নিশিখার ভিডিও দেখে মনে হয়, আকাশের বুকে কেউ আগুনের কলম দিয়ে একটা কিছু লিখে গেছে। ভিডিওটা প্রথম ছড়ায় এক্সে (যা আগে টুইটার নামে পরিচিত ছিল), তারপর তা ছড়িয়ে পড়ে ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুক, ইউটিউব—সবখানে। কেউ বলেছে, এ যেন খোদ শয়তানকে নিশানা করা হয়েছে। আবার কেউ মজা করে লিখেছে, এটা কি অ্যালিয়ে বা গ্রহান্তারের আগন্তকদের অজানা কোনও বার্তা?
কিন্তু এই আগুন-উড়ন্ত বস্তু আদতে একটি বাস্তব অস্ত্র—ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস বা বিপ্লবী রক্ষী বাহিনী সংক্ষেপে আইআরজিসি-এর বানানো ফাত্তাহ নামের একটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। ২০২৩ সালের জুন মাসে ক্ষেপণাস্ত্রটি প্রথমবার প্রকাশ্যে আনা হয়। ‘ফাত্তাহ’ শব্দটি এসেছে আরবি থেকে। অর্থ—‘জয়ী’, ‘বিজয়দানকারী’। নামেই স্পষ্ট ইঙ্গিত, এটি নিছক একটি অস্ত্র নয়। বরং ইরানের আত্মবিশ্বাসের প্রতীক। শত্রুর প্রতি একরকম চ্যালেঞ্জও বলা যায়।
ফাত্তাহ মিসাইলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো এর গতি। শব্দের গতির পনেরো গুণ মানে প্রায় ১৮ হাজার পাঁচশো কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা। এই বেগে চলা কোনো মিসাইলকে ধরার ক্ষমতা বর্তমান পৃথিবীর কোনো প্রচলিত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার নেই—এই দাবি করছে ইরান। যুক্তরাষ্ট্রের প্যাট্রিয়ট সিস্টেম হোক বা ইসরায়েলের আয়রন ডোম ও অ্যারো, কেউই এত দ্রুতগতির, কৌশলগতভাবে দিকবদল করতে সক্ষম এমন ক্ষেপণাস্ত্রকে ঠেকাতে পারবে না, ইরানি কর্মকর্তারা মনে করেন।
এই ক্ষেপণাস্ত্র ওড়ার সময় শুধু গতির জোরেই ভয় ধরায় না। মাঝপথে নিজের গতি এবং দিক পাল্টাতে পারে। ফলে শত্রুপক্ষের রাডার ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পক্ষে ফাত্তাহকে অনুসরণ করা প্রায় অসম্ভব। এই প্রযুক্তিকে বলা হয় ‘ম্যানুভারেবেল হাইপারসনিক গ্লাইড ভেহিকল’, অর্থাৎ নিজের কক্ষপথ পাল্টে শত্রুকে বিভ্রান্ত করতে পারে এমন যান। ফাত্তাহ এই অত্যাধুনিক বৈশিষ্ট্য নিয়েই এসেছে। সলিড ফুয়েল প্রযুক্তিতে তৈরি এই অস্ত্র মাত্র কয়েক মিনিটের প্রস্তুতিতে ছোঁড়া যায়। কঠিন জ্বালানি হওয়ায় ক্ষেপণাস্ত্রটিকে তৈরি অবস্থায়ও রাখা যায় দীর্ঘদিন। ক্ষেপণাস্ত্রের আকৃতি এবং গতির ধরণ দেখে কেউ কেউ বলছেন, এটি রাশিয়ার ‘কিনজাল’ অথবা চীনের ‘ডিএফ-১৭-এর সঙ্গে তুলনীয়। মধ্যপ্রাচ্যের উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে এমন একটি অস্ত্রের প্রদর্শন অনেকের মনে উদ্বেগ বাড়িয়েছে। ফাত্তাহর গতিপথ, গতি এবং প্রতিরক্ষা ফাঁকি দেওয়ার ক্ষমতা পশ্চিমা সামরিক বিশ্লেষকদের ঘুম হারাম করে দিয়েছে।
এর ওয়ারহেড বা বহনকারী বোমার অংশও যথেষ্ট শক্তিশালী। প্রচলিত বোমা বহনের পাশাপাশি, এতে পারমাণবিক ওয়ারহেড বা বোমা বহনের সক্ষমতাও রয়েছে, ধারণা করা হচ্ছে। ইরান আনুষ্ঠানিকভাবে ফাত্তাহর পারমাণবিক সক্ষমতার কথা স্বীকার করেনি। তবে এই ক্ষেপণাস্ত্র পুরোপুরি ইরানের দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি, যা ইরানের স্বনির্ভরতা ও প্রযুক্তিগত বা টেকনোলজিক্যাল সক্ষমতার দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত।
এই ক্ষেপণাস্ত্রের ভিডিও ভাইরাল হয়েছে এমন এক সময়ে, যখন মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক আবহাওয়া আগুনের মতো উত্তপ্ত। ইসরায়েলের সঙ্গে ইরানের ঠান্ডা যুদ্ধ অনেক পুরোনো, তবে সাম্প্রতিক হুমকি, পাল্টা হুমকি এবং হামলার ঘটনায় পরিস্থিতি হয়ে উঠেছে আরও জটিল। ঠিক তখনই সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে ফাত্তাহর সেই ভিডিও। আগুনের শিখা ছুটে চলেছে আকাশে, কেউ ভাবছে এটা মহাকাশ থেকে পড়া উল্কাপিণ্ড, কেউ বলছে,এই কি তাহলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইংগিত?
পশ্চিমা বিশ্ব এই ক্ষেপণাস্ত্রকে হুমকি হিসেবেই দেখছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েলসহ ইউরোপের অনেক দেশই বলছে, এটি শুধু সামরিক ভারসাম্যকেই বিঘ্নিত করবে না, বরং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি গুরুতর হুমকি। সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এখন পর্যন্ত যেসব দেশের হাইপারসনিক প্রযুক্তি রয়েছে, তাদের মধ্যে রাশিয়া ও চীন শীর্ষে। কিনজাল বা ডিএফ-১৭ নামের হাইপারসনিক মিসাইল তাদের হাতে রয়েছে। এই প্রযুক্তির দৌঁড়ে ইরানও এবার পাল্লা দিয়ে উঠেছে। তেহরানে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক অবস্থা পশ্চিমাদের চাপের মধ্যে থাকার সময়ই এমন ঘটনা ঘটিয়ে দিল।
অন্যদিকে, রাশিয়া ও চীনের প্রতিক্রিয়া এই ব্যাপারে নীরব। কিন্তু কৌশলগত দৃষ্টিকোণ থেকে এটা পরিষ্কার, ইরান এখন তাদের অস্ত্রভাণ্ডারে এমন এক গোলা যুক্ত করেছে, যা কেবল আক্রমণ বা প্রতিরক্ষার জন্য নয়—বরং ভূ-রাজনৈতিক আলোচনায় নিজের অবস্থান জানান দেওয়ার এক বলিষ্ঠ পন্থা।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনেয়ী থেকে শুরু করে আইআরজিসি কমান্ডাররা বলছেন, ফাত্তাহ কোনো আগ্রাসনের জন্য তৈরি করা হয়নি। বরং এটি একেবারে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার অংশ। কিন্তু এই ‘প্রতিরোধের’ শক্তিই যদি এত ভয়ানক হয়, তাহলে বিশ্ব স্বাভাবিকভাবেই ভয় পাবে। বিশেষত এমন সময়, যখন ইসরাইলের বালসুলভ তৎপরতার জেরে মধ্যপ্রাচ্য এক অনিশ্চয়তার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে।
এই মিসাইল কেবল অস্ত্র হিসেবে নয়, প্রযুক্তির এক নতুন যুগের প্রতীক। এটি সেই যুগ, যেখানে গতির ওপর নিয়ন্ত্রণ, দিক পাল্টানোর ক্ষমতা, ও প্রতিপক্ষকে বিভ্রান্ত করার কৌশল সবকিছুর সমন্বয়ই নির্ধারণ করবে পরবর্তী যুদ্ধের ভাগ্য। আর সেই যাত্রায় ইরান এখন স্পষ্টতই একটি নতুন অবস্থানে পৌঁছেছে। আইআরজিসি কমান্ডাররা একে স্বনির্ভর প্রযুক্তির গর্ব হিসেবে উপস্থাপন করছেন। ইরানের দাবি, এই ক্ষেপণাস্ত্র পুরোপুরি ইরানে দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি, যা আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও তাদের সামরিক অগ্রগতির প্রমাণ।
সব মিলিয়ে বলা যায়, ফাত্তাহ মিসাইল শুধু ইরানের সামরিক শক্তিরই প্রতীক নয়, বরং এটি এক উত্তাল সময়ের ঘোষণা। সেই সময়, যখন একেকটি আগুনের শিখা আকাশে দেখা গেলেই আর কেউ বলতে পারবে না, এটা কি ড্রাগন? কারণ উত্তর হবে—না, এটা বাস্তব। আর এই বাস্তবই সবচেয়ে ভয়ংকর। আবার অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন,এই অস্ত্র দিয়ে কি শুরু হবে নতুন কোনো যুদ্ধ? তাও না। বরং তেলআবিবের পক্ষ থেকে যে যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে তারই যথাযথ জবাবে এ অস্ত্রকে ছুঁড়বে তেহরান।