ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজায় যুদ্ধ অবসান ও বিধ্বস্ত অঞ্চলটি পুনর্গঠনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি প্রস্তাব দিয়েছেন। প্রস্তাবের অধিকাংশ পরিকল্পনা এসেছে তার পক্ষ থেকেই।
সমর্থন জানিয়ে এই পরিকল্পনায় কিছুটা গতি এনে দিয়েছে জর্ডান, মিসর, কাতার, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া ও তুরস্কেরমতো শীর্ষস্থানীয় আরব ও মুসলিমপ্রধান দেশ।
এমনকি ট্রাম্পের পাশে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ থামাতে তার প্রস্তাবে সম্মতির কথা জানিয়েছেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুও। তবে ট্রাম্পের প্রস্তাবে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয়েছে, যা নেতানিয়াহু বারবার প্রত্যাখ্যান করে আসছেন।
আলোচনার গতি বজায় রাখতে ট্রাম্প বলেছেন, এই প্রস্তাবে হামাস রাজি কি-না, তা জানাতে ‘তিন থেকে চার দিন’ সময় আছে। যদি উত্তর না হয়, তাহলে যুদ্ধ চলবে।
প্রস্তাবিত চুক্তিটি অনেকটাই জো বাইডেনের এক বছরেরও বেশি সময় আগে করা পরিকল্পনার মতো। এরপর থেকে ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের ব্যাপক হত্যাকাণ্ড, গাজায় আরো ধ্বংসযজ্ঞ এবং এখন দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে।
ইসরাইলি গণমাধ্যমে অনেক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। যেখানে বলা হয়, বাইডেনের উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়ার কারণ নেতানিয়াহু তার মন্ত্রিসভার কট্টরপন্থীদের চাপের মুখে নতুন দাবি যুক্ত করেছিলেন।
এতো কিছুর পরেও যুদ্ধ বন্ধে ট্রাম্পের পরিকল্পনা প্রস্তাব একটি উল্লেখযোগ্য মুহূর্ত। প্রথমবারের মতো ডোনাল্ড ট্রাম্প যুদ্ধ শেষ করার জন্য ইসরাইলের ওপর চাপ সৃষ্টি করছেন।
দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় এসে ট্রাম্প নিজেকে এমন একজন নেতা হিসেবে গড়ে তুলেছেন যার সামনে না বলা কঠিন। তাই কেউ চায় না যে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ফেব্রুয়ারিতে ওভাল অফিসে ট্রাম্পের সাথে দ্বিমত পোষণ করে যেরকম পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলেন, তেমন কিছুর মুখোমুখি হতে। ফলে ওভাল অফিসে আলোচনার পর নেতারা হোয়াইট হাউস ছেড়ে গেলে পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে।
যেমন, ট্রাম্পের প্রস্তাবে একটি অংশ ছিল, ইসরাইলের পাশে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র বা ’দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান’। এটি যুক্তরাজ্য ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলোও সমর্থন করে। সম্প্রতি ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়ে সে ধারনার পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টাও করা হচ্ছে।
উভয়মুখী চাপে নেতানিয়াহু?
ট্রাম্পের প্রস্তাবিত নথিতে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার ধারণার প্রতি সমর্থন দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বে রামাল্লাভিত্তিক ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সংস্কারের পর ‘অবশেষে ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণ ও রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার জন্য একটি বিশ্বাসযোগ্য পথ তৈরি হতে পারে, যেটিকে আমরা ফিলিস্তিনি জনগণের আকাঙ্ক্ষা হিসেবে স্বীকৃতি দেবো’।
ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের নূন্যতম সম্ভাবনার কথাও নেতানিয়াহুর কাছে অগ্রহণযোগ্য। অথচ তিনি হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পকে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি গাজায় যুদ্ধ শেষ করার জন্য আপনার পরিকল্পনাকে সমর্থন করি। এটি আমাদের যুদ্ধের লক্ষ্য অর্জন করবে।’
কিন্তু নেতানিয়াহু ওয়াশিংটন ডিসি থেকে ইসরাইলে ফিরে যাওয়ার আগে তার কর্মীরা হিব্রু ভাষায় তার একটি ভিডিও ধারণ করেন। সেখানে তাকে প্রশ্ন করা হয় তিনি কি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের প্রস্তাবনার সাথে একমত?
হিব্রু ভাষায় ইসরাইলের জনগণের কাছে দেয়া তার ওই বার্তায় নেতানিয়াহু বলেন, ‘না, একেবারেই না। চুক্তিতেও এটি লেখা নেই। কিন্তু আমরা একটা কথা পরিষ্কার বলেছি। আমরা জোরালোভাবে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে প্রতিরোধ করব।’
গাজায় যুদ্ধ বন্ধে ট্রাম্পের প্রস্তাবিত পরিকল্পনার শক্তি হলো গতিশীলতা। অর্থাৎ দ্রুততার সাথে ট্রাম্প এটি মীমাংসা করতে চাচ্ছেন। আর এর দুর্বলতা হলো পরিকল্পনা নিয়ে বিস্তারিত তথ্যের অভাব, এটি অবশ্য ট্রাম্পের কূটনীতির একটি বৈশিষ্ট্য।
ট্রাম্প ও নেতানিয়াহু পরিকল্পনার যে নথিটি অনুমোদন করেছেন, তা যুক্তরাজ্য ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলোর সমর্থনও পেয়েছে। তাতে ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী বা আইডিএফ-এর প্রত্যাহারের পর্যায়গুলোর একটি মোটামুটি মানচিত্র রয়েছে। তবে যুদ্ধ বন্ধে প্রস্তাবিত কূটনৈতিক চুক্তিগুলো কিভাবে টিকিয়ে রাখা যায় সেটি নির্ধারণ করার মতো কোনো কৌশল প্রস্তাবনায় নেই।
তাই এই পরিকল্পনা যদি কার্যকর করতে হয়, এর জন্য জোরালো আলোচনার প্রয়োজন হবে। আর সেই আলোচনার টেবিলেই ট্রাম্পের পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ার সুযোগ থাকবে।
যদিও ইসরাইলের মূলধারার বিরোধী দলগুলো এই পরিকল্পনাকে সমর্থন করছে। কিন্তু নেতানিয়াহু জোটের উগ্রপন্থী জাতীয়তাবাদীরা এর নিন্দা করেছে। তারা বরং বছরের শুরুতে ট্রাম্পের প্রস্তাবিত ‘মধ্যপ্রাচ্যের রিভেরা’ পরিকল্পনাটি পছন্দ করেছিল। পরিকল্পনাটিতে গাজার দুই মিলিয়নেরও বেশি ফিলিস্তিনিকে অপসারণ করার কথা উল্লেখ ছিল।
ইহুদি উগ্রপন্থীরা চায় গাজা ভূখণ্ড ইসরাইলের সাথে সংযুক্ত করা হোক এবং ফিলিস্তিনিদের হটিয়ে সেখানে ইহুদি বসতি স্থাপন করা হোক। ফলে ট্রাম্পের দেয়া প্রস্তাব মেনে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিতে রাজি হলে দেশের ভেতরে কট্টরপন্থীদের তোপের মুখে পড়তে পারেন নেতানিয়াহু। আবার ট্রাম্পের প্রস্তাব নাকচ করলে বিশ্বজুড়ে ইসরাইলের মিত্ররা নাখোশ হতে পারে।
এদিকে ট্রাম্পের নতুন পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, কোনো ফিলিস্তিনিকে জোর করে দেশ থেকে বিতাড়িত করা হবে না। অতি-জাতীয়তাবাদী অর্থমন্ত্রী ও বসতি স্থাপনকারী বা সেটলার নেতা বেজালেল স্মোট্রিচ এটিকে ১৯৩৮ সালে স্বাক্ষরিত মিউনিখ চুক্তির সাথে তুলনা করেন। মিউনিখে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স চেকোস্লোভাকিয়াকে নাৎসি জার্মানির কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পরেও তাদের ভূখণ্ড ছেড়ে দিতে বাধ্য করেছিল।
যদি হামাস চুক্তিটি গ্রহণ করে তাহলেও নেতানিয়াহু কট্টরপন্থী স্মোট্রিচ ও তার জোটকে ক্ষমতায় রাখাতে এবং অন্যান্য ইসরাইলি উগ্রপন্থীদের শান্ত করতে, আলোচনার টেবিলে হামাসের ওপর দোষ চাপিয়ে অস্থিরতা ও নাশকতা করার প্রচুর সুযোগ পাবেন।
ট্রাম্পের প্রস্তাবিত চুক্তির কাঠামোতে ইসরাইল পছন্দ করে না এমন অনেক পদক্ষেপে ভেটো দেয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছে। ফলে দশকের পর দশক ধরে চলমান এ গভীর সংঘাতের অবসান ঘটানো সম্ভব না-ও হতে পারে।
এদিকে যুক্তরাজ্য, ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের অনেক দেশ বিশ্বাস করে, যেকোনো দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের প্রচেষ্টা ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দিকে পরিচালিত না হলে এই অঞ্চলে শান্তি আসবে না।
আরব ও মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা যখন ট্রাম্পের পরিকল্পনা প্রস্তাবের সমর্থনে তাদের বিবৃতি জারি করেন, তখন তারা বলেন যে তারা বিশ্বাস করেন, এর ফলে ইসরাইলিদের সম্পূর্ণ প্রত্যাহার ও গাজার পুনর্নির্মাণ হবে এবং ‘দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের ভিত্তিতে ন্যায়সঙ্গত শান্তির পথ তৈরি হবে, যার অধীনে গাজা আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে পশ্চিমতীরের সাথে সম্পূর্ণরূপে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র একীভূত হবে’।
নেতানিয়াহু বিশ্বাস করেন, চুক্তিটি তাকে হামাসের ওপর ইসরাইলের অধরা বিজয়ের কাছাকাছি নিয়ে যাবে। আবার তিনি জর্ডান নদী ও সমুদ্রের মধ্যবর্তী ভূমিতে কোনো ফিলিস্তিন থাকবে এটাও মানতে চান না।
তাই এই পরিকল্পনা প্রস্তাবটির অনেক বিষয় এখনো অস্পষ্ট। ফলে গাজার যুদ্ধ বন্ধে এটি একটি আশাব্যঞ্জক সূচনা তা এখনো বলা যাবে না।
সূত্র : বিবিসি