মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক মানচিত্রে যখন প্রতিদিন নতুন নতুন উত্তেজনার রেখা আঁকা হচ্ছে, ঠিক তখনই ঘটে গেল বোমা ফাটানোর মতো ঘটনা। এই ঘটনা গোটা অঞ্চলকে নাড়িয়ে দিতে পারে। একদিকে ইরানের গোয়েন্দা সংস্থার হাতে ইসরাইলের গোপন পরমাণু নথি এসে পৌঁছেছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা বা আইএইএ-র বিরুদ্ধে উঠেছে ইরানের গোপন তথ্য ফাঁসের গুরুতর অভিযোগ। ঘটনাগুলো শুধু আলাদা দু`টি খবর নয়, বরং একই শীতল যুদ্ধের দুই প্রান্ত। গোপন তথ্য, গুপ্তচর, হত্যা আর প্রতিশোধের এক জটিল খেলায় বাঁধা।
ইরানের অন্যতম জনপ্রিয় দৈনিক হামশাহরি অনলাইন জানায়, একটি বড় ধরনের গোপন তথ্য ফাঁসের ঘটনায় আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ) এবং ইসরাইলের মধ্যে বহুদিনের গোপন আঁতাতের প্রমাণ সামনে এনেছে ইরান। ইহুদিবাদী ইসরাইলে সম্প্রতি ইরানের গোয়েন্দা মন্ত্রণালয়ের এক অভিযানে উদ্ধার হওয়া নথিপত্র থেকে স্পষ্ট যে, আইএইএ সংস্থাটি ইরানের পাঠানো স্পর্শকাতর তথ্য সংবলিত গোপন সরকারি চিঠিপত্র গুপ্ত চ্যানেলের মাধ্যমে পৌঁছে দিচ্ছিল ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থার হাতে।
এই গোপন তথ্য ফাঁসের বিষয়ে একটি অভিজ্ঞ সূত্র হুঁশিয়ারি দিয়ে জানিয়েছে, এই নথিগুলো স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে, আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা এখন আর নিরপেক্ষ কোনো সংস্থা নয়। বরং সংস্থাটি ইহুদিবাদী ইসরাইলের কৌশলগত হাতিয়ার বনে গেছে।
আইএইএ দীর্ঘদিন ধরেই নিজেকে এক নিরপেক্ষ বিশ্ব পরমাণু পর্যবেক্ষক সংস্থা হিসেবে উপস্থাপন করে আসছে। সদস্য রাষ্ট্রগুলোর পারমাণবিক কার্যক্রমের নিরীক্ষা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এ সংস্থার দায়িত্ব। কিন্তু ইরানের এই অভিযানের পর উদ্ধার হওয়া প্রমাণে সংস্থার সেই নিরপেক্ষতা গভীর সংকটে পড়েছে।
গোপন চিঠিপত্রে ছিল এমন সব তথ্য যা ইরানের পরমাণু গবেষণা ও গবেষকদের নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত। এর আগে একাধিকবার ইরানি সংবাদ মাধ্যমে খবর বেরিয়েছে যে, আইএইএ-র ফাঁস করা তথ্যের মাধ্যমে ইরানের পরমাণু বিজ্ঞানীদের নাম এবং পরিচয় ইসরাইলি গোয়েন্দাদের হাতে পৌঁছে যায়। যার পরিণতিতে একাধিক ইরানি বিজ্ঞানী প্রাণ হারিয়েছেন টার্গেটেড অ্যাসাসিনেশন বা নিশানা নির্ধারিত হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে। এবার পাওয়া নথিগুলো সেই আশঙ্কাকেই আরও জোরালো করেছে।
এই নথি ফাঁসের ঘটনা শুধু একটি গোপন আঁতাতের দলিল নয়, বরং এর মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর নিরপেক্ষতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও বড় ধরনের প্রশ্ন উঠেছে। পরমাণু তথ্য ফাঁসের মাধ্যমে একটি দেশের সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ করার যে উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে, তা আন্তর্জাতিক নীতিমালার সরাসরি লঙ্ঘন।
বিশ্লেষকদের মতে, এই ঘটনা শুধু একটি বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়; বরং পশ্চিমা শক্তি ও ইহুদিবাদী দখলদার শাসকগোষ্ঠীর সাথে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর গোপন আঁতাতের একটি পরিষ্কার প্রমাণ। তাদের মতে, এই ধরনের আচরণ আন্তর্জাতিক আইন, সংস্থার গঠনতন্ত্র এবং জাতিসংঘের আদর্শের বিরুদ্ধাচরণ।
এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া হিসেবে ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় খুব শিগগিরই আইএইএ-র বিরুদ্ধে কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে, ধারণা করা হচ্ছে। এমনকি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে বিষয়টি তোলা হতে পারে, ইরানি সূত্র থেকে আভাসও মিলেছে। এর আগে ইরান একাধিকবার সংস্থাটির পক্ষপাতদুষ্ট মনোভাবের অভিযোগ তুললেও এবার তথ্যপ্রমাণ হাতে থাকায় তেহরানের কূটনৈতিক অবস্থান আরও শক্তিশালী হয়েছে।
ইরানের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এখন সময় এসেছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে কঠিন প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়ার, বিশ্বের শান্তি ও নিরপেক্ষতা রক্ষার নামে কাজ করা সংস্থাগুলো আদৌ কতটা নিরপেক্ষ? তারা কি সত্যিই শান্তির সেবক, না কি পর্দার আড়ালে চলছে এক অন্যরকম যুদ্ধ?
সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেছেন, এই ঘটনাগুলো স্পষ্ট করে দেয় যে, আইএইএ নিজ নিরপেক্ষতার নীতি এবং আদর্শ ভুলে গিয়ে ইহুদিবাদী সরকারের লক্ষ্য পূরণের একরকম মাধ্যম হয়ে উঠেছে।
এই পটভূমিতে ইরানের পক্ষ থেকে ঘটেছে পাল্টা এক বিপুল অভিযান। হাশাহরি অনলাইন ও মেহর নিউজের কয়েক দিন আগের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইরানের গোয়েন্দা সংস্থা এক গোপন মিশনে ইসরাইলের পরমাণু স্থাপনা, অবকাঠামো এবং প্রতিরক্ষা পরিকল্পনার, মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে ভবিষ্যত নীল-নকশার সাথে জড়িত হাজার হাজার গোপন নথি, ছবি এবং ভিডিও সংগ্রহ করেছে। ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন একে বলেছে "ইতিহাসের অন্যতম বড় গোয়েন্দা সাফল্য।"
নথিগুলোর নিরাপদে ইরানে ফেরার আগপর্যন্ত গোটা অভিযান ছিল চরম গোপনীয়তায় মোড়ানো। এখন এসব তথ্য ইরানি কর্তৃপক্ষ বিশ্লেষণ করছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, বিপুলসংখ্যক নথিপত্র, চিত্র এবং ভিডিও বিশ্লেষণে দীর্ঘ সময় ব্যয় করছেন ইরানি দুঁদে গোয়েন্দারা।
এই ঘটনার প্রায় ১৭ দিন আগে ইসরাইলের ‘শিন বেত’ ও পুলিশ গ্রেফতার করেছিল দুই ২৪ বছর বয়সী তরুণ—রয় মিজরাহী ও এলমগ আতিয়াসকে। ইসরায়েলের নেসার শহরের এই দুই বাসিন্দার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা ইরানের জন্য গুপ্তচরবৃত্তি করছিল। যদিও ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ তাদের এই গ্রেফতারের সাথে গোপন তথ্য পাচারের সরাসরি সম্পর্ক স্বীকার করেনি, তবুও ইরানি মিডিয়ার দাবি, এই গ্রেফতার অভিযানটি সরাসরি ইরানের গোয়েন্দা অভিযানের সাথে যুক্ত।
বিশ্লেষকদের মতে, এটি সেই দীর্ঘদিনের লুকানো যুদ্ধেরই এক নতুন পর্ব। ইসরাইল যেমন গোপনে এবং প্রকাশ্যে ইরানের ভেতরে অভিযান চালিয়েছে বহুবার, তেমনি ইরানও সাইবার হামলা, ড্রোন আক্রমণ, গোপন সশস্ত্র অভিযান বা গুপ্তচরবৃত্তির মাধ্যমে দিয়েছে তার জবাব। ইরান দীর্ঘদিনের অভিযোগ , ইসরাইল তেহরানের পরমাণু বিজ্ঞানীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে হত্যা করেছে। অন্যদিকে ইসরাইল বলেছে, ইরান মধ্যপ্রাচ্যে কথিত উগ্র গোষ্ঠীগুলোকে সাহায্য দিয়ে তেলআবিবের স্বার্থে আঘাত হানছে।
ইসরাইল আনুষ্ঠানিকভাবে কখনও স্বীকার না করলেও, আন্তর্জাতিকভাবে মনে করা হয় তেলআবিবের হাতে রয়েছে অন্তত ৮০–৯০টি তাজা পরমাণু বোমা। ১৯৮৬ সালে ইসরাইলি পারমাণবিক টেকনিশিয়ান মোর্দেখাই ভানুনু ব্রিটিশ পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিয়ে ডাইমোনার গোপন পরমাণু কেন্দ্রের ছবি এবং তথ্য ফাঁস করেছিলেন। যেখান থেকে বিশ্ব প্রথম জানতে পারে ইসরাইলের পারমাণবিক কর্মসূচির কথা। পরে তাকে অপহরণ করে ইসরাইলে এনে ১৮ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
ইরাকের হাতে কথিত মারণাস্ত্র রয়েছে অভিযোগ তুলে দেশটিতে মার্কিন নেতৃত্বধীন অভিযান চালানো হয়। দেশটিতে রক্তাক্ত এবং লণ্ডভণ্ড করে দেওয়া হয়। কিন্তু কথিত মারণাস্ত্রের হদিস আজও পাওয়া যায়নি। অথচ তেলআবিকের অস্ত্র ভাণ্ডারে পরমাণু বোমাসহ জীবাণু এবং রাসায়নিক মারাণাস্ত্রের বিশাল মজুদের কাহিনি সবার জানা থাকলেও ইরাইলের বিরুদ্ধে আজও ব্যবস্থা দূরে থাক নিন্দা প্রস্তাবও নেওয়া হয়নি। এরপরও পশ্চিমী নীতি ও কূটনীতির দ্বিচারিতার কোনও নজির দরকার আছে বলে মনে করা নেহাৎই জেগে ঘুমানো ছাড়া আর কিছুই নয়।
সেই ‘নিয়ন্ত্রিত গোপন সত্য’, অর্থাৎ পরমাণু বোমা মজুদ থাকার বিষয়টি আজও ইসরাইল অস্বীকার করে চলেছে, কিন্তু তার পরমাণু অস্ত্রের অস্তিত্ব এবং প্রভাব গোটা মধ্যপ্রাচ্যকেই প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে বেড়ায়।
পরমাণু দ্বৈরথের নতুন মোড় নিয়েছে এবারে। ইরানের হাতে ইসরাইলের এই পরমাণু তথ্য চলে আসা নিঃসন্দেহে এক যুগান্তকারী মুহূর্ত। এমন সময়ে এই ঘটনা ঘটল, যখন আমেরিকা ও ইসরাইল বারবার অভিযোগের জিগির তুলছে, ইরান গোপনে পরমাণু বোমা তৈরি করছে। যদিও ইরান বরাবরই জানিয়ে এসেছে, তারা এনপিটি সই করা একটি দেশ এবং শুধু শান্তিপূর্ণ পরমাণু শক্তির ব্যবহার চায়।
অন্যদিকে, ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু প্রকাশ্যে একাধিকবার বলেছেন, ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ইসরাইলের অস্তিত্বের জন্য হুমকি এবং তার স্থাপনাগুলিতে বোমা হামলা চালানো উচিত। এই উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে, ইরানের গোপন অভিযান শুধু প্রতিশোধ নয়, এক কূটনৈতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক বিজয় বলেই বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
গাজা যুদ্ধের মতো সাম্প্রতিক সংঘাতে ইরান-ইসরাইল সম্পর্ক আরও তীব্র হয়েছে। তেহরান ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর থেকেই ইসরাইলকে দখলদার শাসকগোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করে এসেছে। পাশাপাশি ফিলিস্তিনি সংগ্রামের প্রতি প্রকাশ্য সমর্থন জানিয়ে আসছে।
তেহরানের এই নতুন গোয়েন্দা পাল্টা-আক্রমণ সেই পুরোনো সংঘাতকে এক নতুন মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে। ইসরাইলের পরমাণু নথি এখন ইরানের হাতে—এ ঘটনা শুধু দুই দেশের সম্পর্ক নয়, বরং গোটা মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক ভারসাম্যকেই নাড়িয়ে দিতে পারে।
পরবর্তী অধ্যায়ে এই ঘটনার কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া কী হবে, সেটা সময়ই বলবে। তবে এটুকু নিশ্চিত, এক উত্তপ্ত নতুন পর্ব শুরু হয়ে গেছে।