মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে চীনের জোরালো বার্তা

একে নিছকই একটি রাজনৈতিক নাটক বলা যায়। চীনের সামরিক সক্ষমতার প্রদর্শনীর চেয়ে এই বৈঠকটি বরং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বেশি বিরক্ত করেছে বলে মনে হচ্ছে।

নয়া দিগন্ত অনলাইন
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন

চীনের তিয়েনআনমেন স্কয়ারে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে কামানের গোলার শব্দ, আর বেইজিংয়ের সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সেনাদের প্রথম দলটি। কিন্তু এসবের আগেই সামনে এলো দিনটির সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত।

দীর্ঘ সময় ধরে হাত মিলিয়ে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনকে স্বাগত জানান চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। এরপরই অভ্যর্থনা জানাতে এগিয়ে যান রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের দিকে। এর কিছুক্ষণ পর বিশ্বের সবচেয়ে নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত এই দুই নেতাকে পাশে নিয়ে নিজের আসনে বসেন শি।

একে নিছকই একটি রাজনৈতিক নাটক বলা যায়। চীনের সামরিক সক্ষমতার প্রদর্শনীর চেয়ে এই বৈঠকটি বরং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বেশি বিরক্ত করেছে বলে মনে হচ্ছে।

চীনে কুচকাওয়াজ শুরু হওয়ার সাথে সাথে নিজ মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে কঠোর ভাষায় একটি বার্তা পাঠান ট্রাম্প। সেই বার্তায় তিনি এই তিন নেতার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র-বিরোধী ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনেন।

পুরো প্যারেডজুড়ে পুতিনকে ডানে ও কিমকে বামে রেখে প্রেসিডেন্ট শি সম্ভবত এমন প্রতিক্রিয়ারই আশা করেছিলেন। এমনকি এই মুহূর্তটি এমন একজন মার্কিন প্রেসিডেন্টকে ক্ষুব্ধ করার জন্যও তৈরি করা হতে পারে, যিনি সম্ভবত বৈশ্বিক মনোযোগের কেন্দ্রে থাকতেই পছন্দ করেন।

তবে সব মনযোগ মূলত নিজের দিকেই টেনে নিয়েছেন চীনা নেতা। যা ব্যবহার করে তিনি পূর্বাঞ্চলের-নেতৃত্বাধীন একটি জোটের ওপর নিজের ক্ষমতা ও প্রভাব জাহির করতে পেরেছেন। এটি এমন একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী, যা মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিশ্ব ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

ট্রাম্পের নেতৃত্বের নানা কারণে বিশ্ব যখন বিপর্যস্ত, তখন শি’র পক্ষ থেকে এটি একটি জোরালো বার্তা। কিম ও পুতিন ছাড়াও আরো ২০ জনেরও বেশি বিদেশী রাষ্ট্রপ্রধান সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

এই সপ্তাহের শুরুতে, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে শি’র সাক্ষাৎ নিজেদের মধ্যে সমস্যাগ্রস্ত সম্পর্ক পুনর্নির্মাণের কথাও মনে করিয়ে দিচ্ছে। ভারতীয় পণ্য আমদানির ওপর ট্রাম্পের ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্তের কারণে দীর্ঘদিনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ চীন-ভারতের মধ্যে সম্পর্কের বরফ গলতে শুরু করেছে বলেও মনে হচ্ছে।

বুধবার চীনের এই আয়োজনে মূলত জাপানের বিরুদ্ধে ৮০ বছরের বিজয় উদযাপনের কথা ছিল। কিন্তু এটি আসলে ভবিষ্যতে চীন কোথায় যাচ্ছে এবং একজন বিশ্বনেতা হিসেবে শি’র ভূমিকা পালনের বিষয়টিকেই তুলে ধরেছে। আর পশ্চিমাদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো একটি সামরিক বাহিনীও যে চীন গড়ে তুলেছে সেটাও ছিল শি জিনপিংয়ের সামনেই।

চীনের হাতেই এখন ক্ষমতার লাগাম

এই প্রথম একসাথে দেখা গেল শি, পুতিন ও কিমকে। তারা একসাথে, ঐতিহাসিক ‘গেট অব হ্যাভেনলি পিস’ স্কয়ারে উঠলেন সামরিক কুচকাওয়াজ দেখার জন্য। এর প্রতীকী রূপটিও নজর এড়ায়নি।

কমিউনিস্ট চীনের প্রতিষ্ঠাতা মাও জেদং ১৯৪৯ সালে দেশটিতে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছিলেন। ১০ বছর পর সেখানেই তিনি কিমের দাদা কিম ইল-সাং ও সাবেক সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভকে একটি সামরিক কুচকাওয়াজ দেখার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। এটিই ছিল তিন দেশের নেতার শেষবারের মতো একসাথে হওয়া।

তখন কোল্ড ওয়ার পরিস্থিতি ছিল তুঙ্গে। বিশ্বের বেশিভাগ অংশ থেকেই বিচ্ছিন্ন ছিল চীন, যেমনটি ছিল উত্তর কোরিয়াও। আর সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল তাদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ও ধনী। তবে এখন এই সম্পর্কের নিয়ন্ত্রণ চীনের হাতে। পারমাণবিক অস্ত্রধারী, কিন্তু দরিদ্র দেশ হিসেবে উত্তর কোরিয়ার বেইজিংয়ের সাহায্য প্রয়োজন। আর পুতিনের প্রয়োজন সেই বৈধতা, যা শি তাকে দিয়েছেন।

অতীতে পুতিন ও কিমের থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছিলেন শি। তিনি ইউক্রেন যুদ্ধের বিষয়েও প্রকাশ্যে নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রেখেছিলেন বলেই মনে হয়েছিল। অবশ্য এই ঘটনার নিন্দাও করেননি তিনি। এমনকি রাশিয়াকে সাহায্য করার কথাও অস্বীকার করেছিল চীন।

সম্প্রতি রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়া আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। অর্থ ও প্রযুক্তির বিনিময়ে পুতিনের ইউক্রেন আক্রমণকে সমর্থন করার জন্য সৈন্যও পাঠিয়েছেন কিম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে শি তার দুই প্রতিবেশীর পাশে দাঁড়িয়ে আছেন, যদিও তারা কিয়েভ আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে।

কুচকাওয়াজ দেখতে আসা দর্শক ও দেশজুড়ে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে থাকা মানুষের উদ্দেশে শি জিনপিং বলেন, ‘আজ মানবতা আবারো শান্তি অথবা যুদ্ধ, সংলাপ অথবা সংঘর্ষ, জয় অথবা শূন্যের মধ্যে কোনো একটি বেছে নেয়ার মুখোমুখি। চীন একটি মহান জাতি, যারা কখনো কোনো উৎপীড়নে ভীত হয় না।’

সামরিক কুচকাওয়াজটি ছিল শক্তি, নির্ভুলতা ও দেশপ্রেমের প্রদর্শন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের বিরুদ্ধে চীনের বিজয়ের ৮০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ৮০ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট শি তার সৈন্যদের পরিদর্শন করার জন্য প্যারেড রুটের পুরোটা গাড়ি চালিয়ে যান, এরপর তার পাশ দিয়ে পা বাড়িয়ে পালাক্রমে এগিয়ে যায় প্রতিটি যুদ্ধ ইউনিট।

চীনের নতুন অস্ত্র প্রদর্শনের ক্ষেত্রে প্রথমেই ছিল ট্যাংকগুলো। তবে তার পরের অস্ত্রগুলোর তুলনায় এগুলো পুরনো মনে হচ্ছিল। সমুদ্র, স্থল এবং আকাশ থেকে নিক্ষেপযোগ্য একটি নতুন পারমাণবিক-সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য হাইপারসনিক জাহাজ-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র এবং লেজার অস্ত্র। এছাড়া ছিল লক্ষ্যবস্তুতে নজরদারি করতে পারে এবং আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ড্রোনও।

বছরের পর বছর ধরে বিশ্বজুড়ে নানা সংঘাতে জড়িত থাকার মাধ্যমে, এখনো হয়তো যুক্তরাষ্ট্র একটি সুবিধা পাবে। কিন্তু এতে কোনো সন্দেহ নেই যে চীন তার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য একটি সামরিক বাহিনী তৈরি করছে।

বুধবারের শক্তি প্রদর্শন ছিল ওয়াশিংটন ও তার মিত্রদের পাশাপাশি বিশ্বের অন্যান্য অংশের উদ্দেশ্যে একটি বিবৃতি- এমনকি পুতিন ও কিমের প্রতিও, যারা তাদের লক্ষ্যের তাৎপর্য জানতেন। জাতির উদ্দেশে শি বলেন, ‘চীনা জাতির পুনরুজ্জীবন অপ্রতিরোধ্য।’

চিন্তিত পশ্চিমারা

সামরিক ফ্লাইপাস্ট দেখার জন্য মূল প্যারেড রুট থেকে কিছুটা দূরে চীনের টংহুই নদীর ওপরে একটি সেতুতে জড়ো হয়েছিলেন কিছু সাধারণ মানুষ। ৩০ বছর বয়সী এক ব্যক্তি বলেন, ‘প্যারেডটি দেখতে পেয়েছি। এই মুহূর্তটিকে লালন করা আমাদের সবচেয়ে মৌলিক কাজ। আমরা বিশ্বাস করি আমরা ২০৩৫ সালের মধ্যে তাইওয়ান পুনরুদ্ধার করব।’

যে বক্তব্যের ভয়ে ভীত স্বশাসিত দ্বীপ তাইওয়ানের অনেকেই। চীন অবশ্য বিশ্বাস করে, এটি একটি বিচ্ছিন্ন প্রদেশ যা একদিন মাতৃভূমির সাথে একত্রিত হবে। যে লক্ষ্য অর্জনের জন্য শক্তি প্রয়োগের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেননি শি।

বুধবার তিনি যে অস্ত্র প্রদর্শন করেছেন, তার বেশিভাগই চীনের নৌ-ক্ষমতার ওপর জোর দিয়েছিল। যা তাইওয়ানের নেতাদের চিন্তায় ফেলতে বাধ্য। এটি অনেক পশ্চিমা দেশকেও উদ্বিগ্ন করবে। বিশেষ করে ইউরোপে, যারা এখনো ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান ঘটানোর জন্য লড়াই করছে।

পশ্চিমা নেতারা কুচকাওয়াজ এড়িয়ে গেছেন- এমন ধারণাকে উড়িয়ে দেন ৭৫ বছর বয়সী হান ইয়ংগুয়াং। তিনি বলেন, ‘আসবে কি-না, সেটা তাদের ব্যাপার। চীনের দ্রুত উন্নয়নে তারা ঈর্ষান্বিত। সত্যি বলতে, তারা আক্রমণাত্মক। আর আমরা মানবজাতির সাধারণ সমৃদ্ধির জন্য সম্পূর্ণরূপে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা আলাদা।’

এই কুচকাওয়াজ এমন এক সময়ে জাতীয়তাবাদের ঢেউকে উসকে দিচ্ছে যখন চীন গুরুতর অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জের সাথে লড়াই করছে। একটি মন্থর অর্থনীতি, আবাসন সংকট, বয়স্ক জনসংখ্যা, উচ্চ বেকারত্ব এবং স্থানীয় সরকারগুলো ঋণের গভীরে ডুবে আছে।

বিশ্বমঞ্চে চীন যতই আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠুক না কেন, প্রেসিডেন্ট শি’কে অবশ্যই একটি উপায় খুঁজে বের করতে হবে যাতে ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত শ্রেণি তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত না হয়। একসময় চীনের অর্থনৈতিক উত্থান অপ্রতিরোধ্য বলে মনে করা হতো, কিন্তু এখন আর তা নেই।

তাই এই কুচকাওয়াজ পুরোনো শত্রু জাপান সম্পর্কে বাগাড়ম্বরসহ বিভ্রান্তিকরও হতে পারে। পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্রসহ অত্যাধুনিক অস্ত্রের দীর্ঘ প্রদর্শনীর পর, বেইজিংয়ের আকাশে হাজার হাজার ঘুঘু ও বেলুন উড়িয়ে কুচকাওয়াজ শেষ হয়।

গান, মিছিল, ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন, এমনকি ‘রোবট নেকড়ে’ এগুলো থাকলেও চীনের সংগ্রাম সম্পর্কে খুব বেশি কিছু ছিল না এই আয়োজনে। বরং, এটি ছিল চীন কতটা এগিয়েছে এবং কিভাবে এটি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাল মিলিয়ে আধিপত্যের জন্য তাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে তা নিয়ে।

সূত্র : বিবিসি