জেনেভার শান্তিপূর্ণ পরিবেশে যখন জাতিসঙ্ঘের ইউরোপীয় দফতরে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংসদীয় নেতারা মিলিত হয়েছেন, তখনই বজ্রপাতের মতো নেমে আসে উত্তর কোরিয়ার শীর্ষ নেতার হুঁশিয়ারি। পিয়ংইয়ং-এর সর্বোচ্চ গণপরিষদের চেয়ারম্যান পাক ইন-চোল সরাসরি দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়া যৌথভাবে কোরীয় উপদ্বীপে পারমাণবিক যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। আর তা এখন এমন এক বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা আর উপেক্ষা করার সুযোগ নেই।
এই গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যটি প্রকাশ করেছে ইরানের জনপ্রিয় দৈনিক হামশাহরি অনলাইন, রুশ বার্তা সংস্থা তাস-এর বরাত দিয়ে খবরটি দিয়েছে।
‘প্রতিরোধ ছাড়া বাঁচা যাবে না’
জাতিসঙ্ঘের জেনেভা দফতরে অনুষ্ঠিত ‘বিশ্ব সংসদীয় স্পিকারদের ষষ্ঠ সম্মেলন’-এ বক্তব্য রাখতে গিয়ে পাক ইন-চোল বলেন, ‘দক্ষিণ কোরিয়াকে এখন এমন পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে তারা এই ভয়ঙ্কর ভূরাজনৈতিক সঙ্কট মোকাবিলা করতে পারে।’ তিনি আরো বলেন, উত্তর কোরিয়ার জন্য এখন সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো দেশের সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষায় একটি শক্তিশালী প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গড়ে তোলা। ‘আমেরিকা এবং তার স্যাটেলাইট রাষ্ট্রগুলো’ অর্থাৎ তাদের মিত্রগণ বিশ্বব্যাপী নিজেদের আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে ইচ্ছাকৃতভাবে অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে। ‘কিন্তু আমরা আমেরিকার খেয়ালখুশি মতো আচরণ আর সহ্য করব না,’ বলেন পাক। ‘আমরা আন্তর্জাতিক ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াব।’
দক্ষিণ কোরিয়ার বন্ধুত্বের বার্তা, পিয়ংইয়ংয়ের প্রত্যাখ্যান
এই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় সংসদের স্পিকার উ উন-শিক। তিনি তার বক্তৃতায় উত্তর কোরিয়ার সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের আহ্বান জানান।
এক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের বার্তা দিয়ে তিনি বলেন, এখন সময় হয়েছে দ্বিপক্ষীয় উত্তেজনা কমানোর। কিন্তু সেই প্রস্তাবে কোনো ইতিবাচক সাড়া মেলেনি উত্তর কোরিয়া থেকে। বরং সেদিনই পিয়ংইয়ং থেকে আসে তীব্র প্রতিক্রিয়া। উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা কিম জং-উনের বোন এবং দেশটির ক্ষমতাসীন ওয়ার্কার্স পার্টির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য কিম ইয়ো-জং সোমবার একটি বিবৃতিতে বলেন, ‘দক্ষিণ কোরিয়া যদি ভাবে, কিছু আবেগময় কথা বলে তারা তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য ক্ষমা পেয়ে যাবে, তবে সেটাই হবে সবচেয়ে বড় ভুল।’ তিনি আরো বলেন, বর্তমান প্রেসিডেন্ট লি জে-মিয়ং যেভাবে ওয়াশিংটনের সাথে নিরাপত্তা জোটকে অটুট রাখছেন, তাতে তাঁর সাথে আগের নেতাদের কোনো পার্থক্য নেই। ‘মুখে বন্ধুত্বের কথা বলে বাস্তবে মার্কিন নিরাপত্তা চক্রে ঢুকে থাকলে, বিশ্বাসযোগ্যতা থাকে না।’
পারমাণবিক ছায়ায় দুই কোরিয়ার বাস্তবতা
এই পারস্পরিক দোষারোপে স্পষ্ট। উত্তর কোরিয়া মনে করছে, তাদের অস্তিত্বই এখন হুমকির মুখে। আর যুক্তরাষ্ট্র এবং দক্ষিণ কোরিয়া যৌথভাবে তা তৈরি করছে। দক্ষিণ কোরিয়া যদিও কূটনৈতিক পথে চলার ইচ্ছা দেখাচ্ছে, তবে উত্তর কোরিয়ার চোখে তারা আমেরিকার হাতিয়ার।
হামশাহরি অনলাইনের বিশ্লেষণে উঠে এসেছে এ দ্বন্দ্ব এখন শুধু কোরীয় উপদ্বীপেই সীমাবদ্ধ নেই। এটি ধীরে ধীরে বিশ্ব রাজনীতির জন্য এক বড় ঝুঁকির ইঙ্গিত দিচ্ছে।
শান্তির টেবিল না হলে যুদ্ধের ময়দান
এই পরিস্থিতি আমাদের মনে করিয়ে দেয়- শান্তির সুযোগ যখন থাকে, তখন তা কাজে না লাগালে যুদ্ধের দরজা খুলে যায়। জেনেভার সম্মেলন আসলে ছিল সেই শান্তির টেবিল। কিন্তু সেখানে যে ভাষা উচ্চারিত হলো, তাতে বরং অশান্তির আঁচই বেশি পাওয়া গেল। আমেরিকা ও দক্ষিণ কোরিয়ার পক্ষ থেকে যদি কূটনীতির নতুন ভাষা তৈরি না হয়, আর উত্তর কোরিয়া যদি প্রতিরোধকেই একমাত্র পথ ভাবতে থাকে, তবে কোরীয় উপদ্বীপের ভবিষ্যৎ সত্যিই অন্ধকার। আর সেই আঁধার ছড়িয়ে পড়বে শুধু পূর্ব এশিয়ায় নয়, পুরো বিশ্বেই।