মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতে, চীন তার প্রচলিত সামরিক শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি তার পারমাণবিক বাহিনীর আকার ও সক্ষমতার দ্রুত এবং টেকসই সম্প্রসারণ শুরু করেছে।
মার্কিন কৌশলগত কমান্ডার অ্যান্থনি কটন ২০২৫ সালের মার্চ মাসে মার্কিন কংগ্রেসকে বলেছিলেন যে চীনের পারমাণবিক অস্ত্রাগার সম্প্রসারণকে আরো বাড়িয়ে তোলার জন্য দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের আদেশে ২০২৭ সালের মধ্যে তাইওয়ানকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য দেশটির সেনাবাহিনী প্রস্তুতি নিচ্ছে; যার ফলে স্থল, আকাশ ও সমুদ্র থেকে নিক্ষেপযোগ্য পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
গত বছরের শেষের দিকে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে পেন্টাগন বলেছে, তাইওয়ানে প্রচলিত সামরিক পরাজয় ‘চীনা রাষ্ট্রের অস্তিত্বের জন্য গুরুতর হুমকি’ হলে বেইজিং সম্ভবত পারমাণবিক অস্ত্রের প্রথম ব্যবহারের কথা বিবেচনা করবে।
ওয়াশিংটনের অভিযোগের জবাবে চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, তারা ‘বেইজিংকে অপমান ও দুর্বল করার জন্য এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ইচ্ছাকৃতভাবে বিভ্রান্ত করার জন্য চীনের তথাকথিত পারমাণবিক হুমকিকে অতিরঞ্জিত করার যেকোনো প্রচেষ্টার’ বিরোধিতা করে।
২০২৩ সালের জাতীয় প্রতিরক্ষা নীতি নথিতে চীন তার দীর্ঘস্থায়ী প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছে, তারা কোনো পরিস্থিতিতেই পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারকারী প্রথম দেশ হবে না। তথাকথিত ‘প্রথমে ব্যবহার না করা’ নীতিতে একটি ধারাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে যে চীন কোনোও অ-পারমাণবিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে না বা পারমাণবিক অস্ত্র দিয়ে সেই রাষ্ট্রগুলোকে হুমকি দেবে না।
চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ‘একটি পারমাণবিক যুদ্ধ জয় করা যায় না এবং শুরু করা উচিত নয়।’ মন্ত্রণালয় আরো জানিয়েছে যে চীন ‘আত্মরক্ষার পারমাণবিক কৌশল এবং প্রথম ব্যবহার না করার নীতি’ মেনে চলে।
চীনের সামরিক শক্তি সম্পর্কে তার বার্ষিক প্রতিবেদনে পেন্টাগন জানিয়েছে, চীনের জনসাধারণের অবস্থান সত্ত্বেও তার কৌশলে সম্ভবত প্রচলিত আক্রমণের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য প্রথম ব্যবহারের প্রতিক্রিয়া অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে, যা তার পারমাণবিক বাহিনী কমান্ড ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাকে হুমকির মুখে ফেলে, অথবা পারমাণবিক আক্রমণের মতো প্রভাব ফেলে।
চীনের পারমাণবিক অস্ত্রাগার সম্প্রসারণকে আরো বর্ধিত করার মার্কিন লক্ষ্যকে বিভিন্ন কৌশলগত এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে পরীক্ষা করা যেতে পারে।
কৌশলগত ও সামরিক উদ্দেশ্য
পারমাণবিক শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখা : চীন দ্রুত তার পারমাণবিক ওয়ারহেডের সংখ্যা বৃদ্ধি করছে, যা ২০৩০ সালের মধ্যে ১,০০০-এরও বেশি পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই দ্রুত বৃদ্ধি ঐতিহ্যবাহী মার্কিন শ্রেষ্ঠত্বকে চ্যালেঞ্জ করে।
ত্রিপোলার প্রতিরোধ : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের চীন ও রাশিয়ার মধ্যে একটি নতুন পারমাণবিক ভারসাম্যের উত্থান নিয়ে উদ্বিগ্ন, যা শীতল যুদ্ধের সময়ের তুলনায় অনেক বেশি অস্থিতিশীল বলে মনে করা হয়।
রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক লক্ষ্য
চীনের উপর আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধি : চীনের পারমাণবিক হুমকি তুলে ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বেইজিংয়ের সামরিক নীতির বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী জনমতকে একত্রিত করার এবং এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তার কর্মকাণ্ডের বৈধতা জোরদার করার চেষ্টা করছে।
নিজস্ব অস্ত্রের পক্ষে যুক্তি : চীনের হুমকিকে অতিরঞ্জিত করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সামরিক বাজেট বৃদ্ধি ও নতুন অস্ত্রাগার তৈরির একটি অজুহাত হতে পারে।
সংক্ষেপে, চীনের পারমাণবিক অস্ত্রাগার সম্পর্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অতিরঞ্জিত বক্তব্য কেবল বাস্তব বা সম্ভাব্য হুমকির প্রতি প্রতিক্রিয়া নয়। বরং ওয়াশিংটনের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতি গঠনের একটি হাতিয়ারও। মনে হচ্ছে, চীনের পারমাণবিক অস্ত্রাগার সম্প্রসারণকে অতিরঞ্জিত করে তোলা এবং এটি হুমকিস্বরূপ বলে দাবি করার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য হলো বেইজিংয়ের ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে ভয় তৈরি করা এবং তাদের নিরাপত্তার দিক থেকে ক্রমশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ঘনিষ্ঠ হতে, নতুন অস্ত্র কিনতে ও মার্কিন তত্ত্বাবধানে সামরিক জোটে যোগদান করতে উৎসাহিত করা। এছাড়া চীনের পারমাণবিক অস্ত্রাগার সম্প্রসারণ সম্পর্কে মার্কিন উদ্বেগ দুই দেশের সম্পর্কের উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে যা বিভিন্ন স্তরে পরীক্ষা করা যেতে পারে।
ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার তীব্রতা
ক্রমবর্ধমান অবিশ্বাস : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন ক্রমবর্ধমানভাবে একে অপরকে সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের জন্য অভিযুক্ত করছে। এই অবিশ্বাস কূটনৈতিক আলোচনার পরিবেশকে অন্ধকার করে দিয়েছে।
অস্ত্র প্রতিযোগিতা : চীনের হুমকি তুলে ধরে আমেরিকা তার অস্ত্রাগার সম্প্রসারণের জন্য একটি অজুহাত খুঁজে পেয়েছে, এবং প্রতিক্রিয়ায় চীন তার পারমাণবিক সক্ষমতা জোরদার করার উপর জোর দিচ্ছে।
কৌশলগত সংলাপ দুর্বল করা
অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় বিঘ্ন ঘটেছে : যদিও ওয়াশিংটন এবং বেইজিংয়ের মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্রের ক্ষেত্রে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে, মার্কিন চীন-বিরোধী কৌশল প্রকাশের ফলে দুই দেশের মধ্যে ‘মিডিয়া যুদ্ধ’ শুরু হয়েছে এবং আলোচনার পরিবেশ বিষিয়ে উঠেছে।
চীনের অস্ত্র প্রতিযোগিতা প্রত্যাখ্যান : চীন বারবার বলেছে, তারা অস্ত্র প্রতিযোগিতায় জড়িত হতে চায় না। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই অবস্থানকে সন্দেহের চোখে দেখে। এটিকে তারা পয়েন্ট অর্জনের কৌশল বলে মনে করে।
আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রভাব
এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা : তৃতীয় পারমাণবিক শক্তি হিসেবে চীনের উত্থান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে ঐতিহ্যবাহী ভারসাম্যকে বিপর্যস্ত করেছে এবং এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অস্থিতিশীলতার সম্ভাবনা বাড়িয়েছে।
প্রতিরোধের তত্ত্ব পরিবর্তন : প্রতিরোধের ধ্রুপদী তত্ত্ব দু’টি পারমাণবিক শক্তির উপর ভিত্তি করে তৈরি। এই সমীকরণে চীনের প্রবেশ কৌশলগত গণনাকে জটিল করে তুলেছে এবং মিথ্যা ও হুমকিস্বরূপ ধারণার সম্ভাবনা বাড়িয়েছে।
সূত্র : পার্সটুডে