যুক্তরাষ্ট্র কেন পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষার উদ্যোগ নিচ্ছে

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগকে অবিলম্বে পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষার নির্দেশ দিয়েছেন।

নয়া দিগন্ত অনলাইন
ডোনাল্ড ট্রাম্প
ডোনাল্ড ট্রাম্প |সংগৃহীত

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগকে অবিলম্বে পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষার নির্দেশ দিয়েছেন। এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে পারমাণবিক ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি সর্বশেষ পারমাণবিক পরীক্ষা চালিয়েছিল ১৯৯২ সালে অর্থাৎ ৩৩ বছর আগে।

ট্রাম্প তার ট্রুথ সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে দাবি করেন, ‘অন্যান্য দেশের পরীক্ষামূলক কর্মসূচির কারণে আমি আমাদের প্রতিরক্ষা বিভাগকে পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা শুরু করার নির্দেশ দিয়েছি।’

তিনি আরো বলেন, চীন দ্রুত তার পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার সম্প্রসারণ করছে। তারা পাঁচ বছরের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের সমকক্ষ হয়ে উঠবে। এই ঘোষণা এসেছে এমন এক সময়ে, যখন ট্রাম্প চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সাথে দক্ষিণ কোরিয়ায় অনুষ্ঠিত এশিয়া-প্যাসিফিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা (এপেক) সম্মেলনে বৈঠকে অংশ নিচ্ছিলেন। এর মাত্র কয়েকদিন আগে তিনি রাশিয়ার ‘বুরেভেস্টনিক’ নামক পারমাণবিকচালিত ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা নিয়ে মস্কোর তীব্র সমালোচনা করেছিলেন।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সম্প্রতি ঘোষণা করেছেন, তারা সফলভাবে ‘বুরেভেস্টনিক’ নামের একটি পারমাণবিকচালিত ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র এবং ‘পোসেইডন’ নামের এক ডুবো পারমাণবিকচালিত ড্রোন পরীক্ষা সম্পন্ন করেছে। পুতিনের ভাষায়, ‘গতি ও গভীরতার দিক থেকে পৃথিবীতে এর মতো কিছু নেই এবং সম্ভবত কখনো হবেও না।’ যদিও এই পরীক্ষাগুলোতে পারমাণবিক ওয়ারহেড ব্যবহার করা হয়নি। তবু এগুলো ভবিষ্যতে পারমাণবিক অস্ত্রে রূপ নিতে সক্ষম প্রযুক্তির ইঙ্গিত দেয়।

ফেডারেশন অব আমেরিকান সায়েন্টিস্টস ও স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এসআইপিআরআই) তথ্য অনুযায়ী, চীনের পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডারে ২০২২ সালে ৩৫০টি ওয়ারহেড ছিল। ২০২৩ সালে এই সংখ্যা ৪১০-এ গিয়ে পৌঁছে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের হাতে রয়েছে ৩,৭০৮টি ওয়ারহেড, অর্থাৎ চীনের প্রায় নয়গুণ। রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র সংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রের সমান প্রায়। তবে ২০২৩ সালে পুতিন সিটিবিটি অনুমোদন প্রত্যাহার করে নেন, যা তাদেরকে পারমাণবিক পরীক্ষা চালানোর পথ খুলে দেয়।

যুক্তরাষ্ট্র সর্বশেষ পারমাণবিক পরীক্ষা চালিয়েছিল ১৯৯২ সালে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৯০ সালে, চীন ১৯৯৬ সালে, ফ্রান্স ১৯৯৬ সালে এবং যুক্তরাজ্য ১৯৯১ সালে। ভারত ও পাকিস্তান ১৯৯৮ সালে পরস্পরের কয়েক দিনের ব্যবধানে পারমাণবিক পরীক্ষা চালায়, আর উত্তর কোরিয়া ২০০৬, ২০০৯, ২০১৩, ২০১৬ (দুবার) ও ২০১৭ সালে ছয় দফা পরীক্ষা করেছে। বর্তমান বিশ্বে পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশ নয়টি—যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, চীন, ভারত, পাকিস্তান, উত্তর কোরিয়া ও ইসরাইল। ইসরাইল তার অস্ত্রভাণ্ডার নিয়ে ‘পারমাণবিক অস্পষ্টতা’ নীতি বজায় রেখেছে। স্বীকারও করছে না, আবার অস্বীকারও করছে না।

১৯৯৬ সালের বিস্তৃত পারমাণবিক পরীক্ষা-নিষেধ চুক্তি (সিটিবিটি) সামরিক ও বেসামরিক উভয় উদ্দেশ্যেই সব ধরনের পারমাণবিক বিস্ফোরণ নিষিদ্ধ করে। যুক্তরাষ্ট্র চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেও কখনো অনুমোদন করেনি। ফলে দেশটি আইনত বাধ্য নয়। অন্যদিকে, রাশিয়া চুক্তি অনুমোদন করলেও ২০২৩ সালে তা প্রত্যাহার করেছে।

এসআইপিআরআই-এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ব একটি নতুন পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতার দোরগোড়ায় রয়েছে। যদিও বিশ্বজুড়ে মোট ওয়ারহেড সংখ্যা কিছুটা কমছে (পুরোনোগুলোর ধ্বংসের কারণে)। তবুও নতুন ও উন্নত পারমাণবিক ওয়ারহেড যোগ হচ্ছে দ্রুত। বিশ্লেষকদের মতে, যদি পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তিগুলো ভেঙে পড়ে, তাহলে এই বৃদ্ধি অবশেষে আগের ভাণ্ডারগুলোকেও ছাড়িয়ে যাবে। এতে একটি নতুন স্নায়ুযুদ্ধ যুগের সূচনা হতে পারে।

গত কয়েক দশকে পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের জন্য গৃহীত প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি বাতিল বা স্থগিত হয়েছে। ১৯৭২ সালের অ্যান্টি-ব্যালিস্টিক মিসাইল (এবিএম) চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র ২০০২ সালে সরে যায়। ১৯৭৯ সালের SALT II চুক্তি কখনো অনুমোদিত হয়নি এবং ১৯৮০ সালে সোভিয়েত আফগানিস্তান আক্রমণের পর যুক্তরাষ্ট্র তা থেকে সরে দাঁড়ায়। ১৯৮৭ সালের আইএনএফ চুক্তি থেকেও যুক্তরাষ্ট্র ২০১৯ সালে প্রত্যাহার করে নেয়, রাশিয়ার লঙ্ঘনের অভিযোগে। একইসাথে ইরান পারমাণবিক অ-বিস্তার চুক্তি (এনপিটি) থেকে বেরিয়ে আসার হুমকি দিয়েছে, আর উত্তর কোরিয়া ২০০৩ সালে তা থেকে সরে গেছে।

৩৩ বছর পর যুক্তরাষ্ট্র যদি সত্যিই নতুন পারমাণবিক পরীক্ষা চালায়, তা শুধু বৈশ্বিক নিরাপত্তার জন্য নয়। আন্তর্জাতিক কূটনীতির জন্যও এক অস্থির বার্তা হবে। চীন ও রাশিয়ার সাথে ক্রমবর্ধমান ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, এবং অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তির ক্রমাগত পতন—সব মিলিয়ে বিশ্বের পরাশক্তিগুলোকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে এক নতুন পারমাণবিক প্রতিযোগিতার যুগে, যা স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী শান্তির অর্জনকে আবারও বিপন্ন করতে পারে।

সূত্র : আল জাজিরা