মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আজ সোমবার ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সাথে বৈঠকে বসছেন। চলতি বছরের শুরুর দিকে হোয়াইট হাউজে ট্রাম্পের সাথে উত্তপ্ত বাগ্বিতণ্ডার পর দুই নেতার মধ্যে এটিই প্রথম সাক্ষাৎ। তবে এবার ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের সাথে থাকছেন ইউরোপীয় মিত্ররাও।
ন্যাটো মহাসচিব মার্ক রুট ও যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ার স্টারমারসহ আরো কয়েকজন নেতা ওয়াশিংটনে জেলেনস্কির সাথে ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান নিয়ে আয়োজিত এই বৈঠকে যোগ দেবেন।
গত শুক্রবার আলাস্কায় ট্রাম্প-পুতিন বৈঠকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট একটি স্থায়ী শান্তি চুক্তির প্রচেষ্টা চালালেও যুদ্ধবিরতির ঘোষণা আসেনি, আসেনি কোনো বড় অর্জনও। এর তিনদিনের মাথায় জেলেনস্কি ও ইউরোপীয় নেতাদের সাথে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। যে কারণে এই বৈঠকটি স্বাভাবিকভাবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা, এর আগে দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশ রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বৈঠকে কি হয়েছে, তা নিয়ে স্পষ্ট কোনো ঘোষণা ছিল না।
যে কারণে ইউরোপীয় নেতারা সোমবারের বৈঠকে একটি বিষয় গুরুত্বের সাথে তুলে ধরতে চাইবেন, আর সেটি হলো ইউক্রেনের অনুপস্থিতিতে সে দেশটিকে নিয়ে কোনো চুক্তি যেন না হয়। অন্যদিকে কোনো চুক্তি হলে সেটি যেন শক্তিশালী নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দিয়ে সুরক্ষিতও করা যায়।
রোববার একজন মার্কিন দূত জানিয়েছে, পুতিন ইউক্রেনের জন্য ন্যাটো-সদৃশ নিরাপত্তা চুক্তিতে সম্মত হয়েছেন। ট্রাম্পও তার ট্রুথ সোশ্যালে লিখেছেন, ‘রাশিয়ার ক্ষেত্রে বড় অগ্রগতি হয়েছে। সাথে থাকুন।’ তবে এর বাইরে বিস্তারিত কিছু তিনি লেখেন নি।
সোমবারের বৈঠকের জন্য ওয়াশিংটনের পথে রয়েছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ, ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি, জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মার্জ, ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার স্টাব ও ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন দার লেয়েন।
কিন্তু তাদের সবাই হোয়াইট হাউজে যাবেন কি-না, সেটি এখনো স্পষ্ট নয়। এত অল্প সময়ে আটলান্টিক পেরিয়ে এতগুলো রাষ্ট্রপ্রধানের যাত্রার ঘটনা নজিরবিহীন। তবে, সংকট যে এতটা গুরুত্বর সেটিই হয়তো এর অন্যতম কারণ।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, ইউরোপীয় কর্মকর্তারা উদ্বিগ্ন এই কারণে, ট্রাম্প হয়তো জেলেনস্কিকে কিছু শর্তে রাজি করানোর জন্য চাপ দিতে পারেন। বিশেষ করে গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে জেলেনস্কিকে বাদ দিয়ে পুতিনের সাথে ট্রাম্পের বৈঠকের কারণেই ইউরোপিয়ান নেতাদের এই উদ্বেগ।
তবে, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বিবিসির অংশীদার সিবিএসকে বলেন, জেলেনস্কিকে ট্রাম্পের জোর করে কোনো শান্তিচুক্তিতে রাজি করানোর বিষয়টি একটি হাস্যকর মিডিয়া গল্প।
গত ফেব্রুয়ারিতে ট্রাম্প-জেলেনস্কি বৈঠকে যে উত্তপ্ত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, তার পুনরাবৃত্তি চান না ন্যাটো নেতারাও।
সেই বৈঠকে ট্রাম্প জেলেনস্কিকে বলেছিলেন, ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে জুয়া খেলছেন’ জেলেনস্কি। যা ওয়াশিংটন-কিয়েভ সম্পর্ককে অনেকটা নড়বড়েও করে দিয়েছিল।
ওই ঘটনার পর থেকে ইউরোপীয় নেতারা সম্পর্ক পুনর্গঠনে পর্দার আড়ালে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। জেলেনস্কিকে চুক্তি করার ক্ষেত্রে আরো কৌশলী ভাষা ব্যবহারের পরামর্শও দিয়েছেন ইউরোপীয় নেতারা। যেন ট্রাম্প কোনো কারণে নাখোশ না হন কিংবা এমন ভাষায় কথা বলার কথা বলছেন তারা, যা ট্রাম্পকে আরো বেশি অনুপ্রাণিত করে।
গত এপ্রিল মাসে ইউক্রেন একটি খনিজসম্পদ চুক্তি সই করে, যাতে যুক্তরাষ্ট্র দেশটিতে আর্থিকভাবে অংশীদারও হয়। একই মাসে ভ্যাটিকানে পোপ ফ্রান্সিসের শেষকৃত্যে ট্রাম্প ও জেলেনস্কি ব্যক্তিগতভাবে কথাও বলেন। তখন যুক্তরাষ্ট্র থেকে অস্ত্র কেনার আগ্রহও দেখায় ইউক্রেন।
গত জুলাইয়ে দুই নেতার মধ্যে ফোনালাপ হয়, এই ফোনালাপকে জেলেনস্কি খুব গুরুত্বপূর্ণ ও ফলপ্রসূ বলেও উল্লেখ করেছিলেন। এরপরই ট্রাম্প ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা নিয়ে ক্রমেই বিরক্তি প্রকাশ করতে শুরু করেছিলেন। পুতিনকে ‘উন্মাদ’ বলেও আখ্যায়িত করেছিলেন তিনি এবং মস্কোর উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিয়েছিলেন।
একদিকে এই আলোচনা যখন চলছিল তখন রুশ সেনারা ইউক্রেনের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রার আগ্রাসন শুরুর পর থেকে তারা ইতোমধ্যে ইউক্রেনের প্রায় পাঁচভাগের একভাগ দখল করে নিয়েছে।
রোববার জেলেনস্কি ইউরোপিয়ান নেতাদের সাথে একটি ভার্চুয়াল সম্মেলনে যোগ দেন। যেখানে ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, জার্মানিসহ ইউরোপিয়ান জোটের নেতারা ইউক্রেনকে রক্ষার প্রতিশ্রুতিও ব্যক্ত করেন। এরপরই ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ সাংবাদিকদের বলেন, তাদের পরিকল্পনা হলো সোমবার ট্রাম্পের সাথে বৈঠকে ইউরোপিয়ানদের ঐক্যবদ্ধ অবস্থান তুলে ধরা।
শুক্রবার মার্কিন দূত স্টিভ উইটকফ মার্কিন টেলিভিশনকে জানান, শুক্রবার পুতিন যে শক্তিশালী নিরাপত্তা নিশ্চয়তায় রাজি হয়েছে। সেটিকে ‘গেম চেঞ্জিং’ হিসেবেই আখ্যা দেন তিনি। উইটকফ বলেন, এমন একটি চুক্তির ইউক্রেনকে ভবিষ্যৎ আগ্রাসন থেকে রক্ষা করতে পারে।
আলাস্কা বৈঠকের পর ইউরোপীয় মিত্রদের সাথে আলোচনায় ট্রাম্প বলেন, পুতিন দনবাসের গুরুত্বপূর্ণ দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক অঞ্চলগুলো নিজের দাবি পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
কিন্তু রোববার ন্যাটো নেতাদের সাথে ভার্চুয়াল বৈঠকে জেলেনস্কি জোর দিয়ে বলেন, ইউক্রেনের সংবিধান অনুযায়ী কোনো ভূখণ্ড ছেড়ে দেয়া সম্ভব নয়।
সূত্র : বিবিসি