মরক্কোয় কী ঘটছে এবং কেন

গত শনিবার সকাল থেকে মরক্কোর বিভিন্ন শহরে আন্দোলন হচ্ছে। আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছে জেনারেশন জেড-২১২।

নয়া দিগন্ত অনলাইন
মরক্কোয় জেন-জির আন্দোলনের চিত্র
মরক্কোয় জেন-জির আন্দোলনের চিত্র |আল জাজিরা

গত শনিবার সকাল থেকে মরক্কোর বিভিন্ন শহরে আন্দোলন হচ্ছে। আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছে জেনারেশন জেড-২১২। এই আন্দোলনের প্রেক্ষাপট, কারণ ও ফলাফল নিয়ে বিশদভাবে তুলে ধরা হলো-

আন্দোলন কেন হচ্ছে?

জেন-জিদের এই আন্দোলন গত শনিবার (২৭ সেপ্টেম্বর) শুরু হয়। এরপর ক্রমাগত তা বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়ে। অবশ্য গত কয়েক বছর ধরেই দেশটিতে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। অবশ্য এর পেছনে পণ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি, স্বাস্থ্যসেবার অবনতি, বেকারত্বের হার বাড়া ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের দুর্নীতি নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে।

গত কয়েক মাস ধরে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন বিচ্ছিন্নভাবে এস বিষয়ে নিজেদের উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রতিবাদ হয় ২০২৫ সালের ১০ জুলাই। তারা মধ্য মরক্কোর আজিলাল প্রদেশের আইত বোকামাজ থেকে কেন্দ্রের দিকে লংমার্চ করে। এতে ওই এলাকার অন্তত তিন হাজার মানুষ অংশ নিয়েছে। তারা অনেক দূর পথ পাড়ি দিয়ে প্রাদেশিক কেন্দ্রে পৌঁছায় এবং ওই অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতা, গ্রামে গ্রামে অন্তত একজন করে চিকিৎসক দেয়া, পর্যাপ্ত টেলিফোন নেটওয়ার্কের ব্যবস্থা করা ও অন্যান্য সামাজিক সুবিধার দাবি জানায়।

এরপরের সপ্তাহগুলোতে আরো কিছু প্রদেশে অনুরূপ লংমার্চ ও বিক্ষোভ মিছিল হতে শুরু করে। তারাও একে একে নিজেদের যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন ও কেন্দ্রের সাথে তাদের বিচ্ছিন্নতা দূরীকরণের উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানায়।

পরে জুলাইয়ের শেষ দিকে দেশটির রাজা মোহাম্মদ আস-সাদেস জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। সেখানে তিনি বলেন, ‘তার দেশ খুবই দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। কিছু অঞ্চল তো রীতিমতো বিস্ময়কর অগ্রগতি অর্জন করেছে। তবে ‍দুঃখজনক বিষয় হলো এই, এখনো কিছু কিছু প্রত্যন্ত এলাকায় উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। তারা মৌলিক সুযোগ-সুবিধা ও অবকাঠামোগত উন্নতি থেকেও বঞ্চিত। ফলে দারিদ্র্য ও ভঙ্গুরতার শিকার তারা। তাদের এই দুরাবস্থা চলতে দেয়া যায় না। একই দেশে দুই ধরনের পরিস্থিতি থাকতে পারে না।’

এরপর উত্তেজনা মোটামুটি কমে যায়। পরে ১৪ সেপ্টেম্বর নতুন করে বিক্ষোভ শুরু হয়। শত শত মানুষ দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর আগাদিরের হাসান আস-সানি হাসপাতালের সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ শুরু করে। তারা জানায়, গত এক মাসেরও কম সময়ে স্বাস্থ্যসেবার অবনতির কারণে অন্তত আটজন নারী মারা গেছে। এরই মধ্যে হাসপাতালটির নাম ‘যমের হাসপাতাল’ পড়ে গেছে। এ সময় তারা স্বাস্থ্যখাতের উন্নতির দাবি জানায়।

জেন-জির আন্দোলন কবে শুরু হয়?

জেন-জি-২১২ এর আন্দোলন গত শনিবার (২৭ সেপ্টেম্বর) শুরু হয়। এরপর থেকে প্রতিদিনই আন্দোলন চলছে। এটি ক্রমেই রাবাত, কাসাব্লাঙ্কা, আগাদির ও টাঙ্গিয়ার মতো শহরগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ছে। এখন অন্যান্য আরো শহরে ছড়িয়ে পড়ছে।

কারা এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছে?

মূলত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তরুণদের একটি দল এই বিক্ষোভ আন্দোলনের ডাক দিয়েছে। তারা নিজেদেরকে জেন-জি-২১২ বলে পরিচয় দিচ্ছে।

জেন-জি-২১২ নামটিতে দুই ধরনের শব্দ আছে। একটি হলো জেন-জি। অন্যটি ২১২। উভয় শব্দে আলাদা আলাদা ইঙ্গিত রয়েছে।

জেন-জি দ্বারা ১৯৯০ দশকের মাঝামাঝি ও একবিংশ শতাব্দির দ্বিতীয় দশকের শুরুর মধ্যে জন্মগ্রহণকারী প্রজন্মকে বুঝায়। পিও রিসার্চ সেন্টারের মতে, সাধারণত এর দ্বারা ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের সময়কালকে বোঝানো হয়। এটি এমন সময়, যেখানে ব্যাপকভাবে স্মার্টফোনের ব্যবহার শুরু হয় এবং সোশ্যাল মিডিয়ার উত্থান ঘটে; যা এখন প্রাত্যহিক জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি তাৎক্ষণিক যোগাযোগ ও ডিজিটাল উপস্থিতি তাদের সামাজিক ও সভ্যতার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দ্বিতীয় শব্দ হলো ২১১। এটি মরক্কোর আন্তর্জাতিক ডায়ালিং কোড। এই জেন-জি-২১২ প্রজন্ম বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম -টিকটক, ইনস্ট্রাগ্রাম, ফেসবুক, ডিসকোর্ডের- মাধ্যমে জনমত গঠন করে। গত সপ্তাহে বিক্ষোভের শুরু থেকে গ্রুপটির ডিসকর্ড সার্ভারের সদস্য সংখ্যা প্রায় ৩,০০০ থেকে বেড়ে পাঁচ দিনে ১ লাখ ৩০ হাজারেরও বেশি হয়েছে।

কোন কোন শহরে বিক্ষোভ হচ্ছে?

মরক্কোর বেশ কিছু শহরে এই বিক্ষোভ চলছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-

রাজধানী রাবাত এবং তার পার্শ্ববর্তী শহর সালে, তেমারা, স্কিরাত, কেনিত্রা এবং সিদি স্লিমানে (পশ্চিম); কাসাব্লাঙ্কা ও মোহাম্মদিয়া (পশ্চিম-মধ্য) শহর; টাঙ্গিয়ার এবং তেতুয়ান (উত্তর) শহর; আগাদির, ইনজেগান, তিজনিত, তারউদান্ত, বুয়াক্রী, এল কোলিয়া এবং সিদি বিবি (দক্ষিণ) শহর; মারাক্কেশ এবং সাফি শহর (দক্ষিণ-মধ্য); ওজদা, তাজা এবং লায়ুন ওরিয়েন্টাল (পূর্ব) শহর; ফেজ ও মেকনেস শহর (উত্তর-পশ্চিম); ইরাচিডিয়া শহর (দক্ষিণ-পূর্ব)

বেনি মেল্লাল, খুরিব্গা এবং ফকিহ বেন সালাহ (কেন্দ্রীয়) শহর।

এই বিক্ষোভে কী কী ক্ষতি হয়েছে?

কিছু কিছু শহরে বিক্ষোভের পর ব্যাপক দাঙ্গা ও লুটপাট হয়েছে। বিশেষ করে ওয়াজদা, এল কালা, ইনজেগান ইত্যকার শহরে বেশি অস্থিতিশীলতা দেখা গেছে। সেখানে তিনজন নিহত ও কয়েক ডজন আহত হয়েছে।

এদিকে, দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর আগাদিরের নিকটবর্তী এল কালা এলাকায় বিক্ষোভকারীরা স্থানীয় নিরাপত্তা বাহিনীর উপর হামলা করে তাদের সদর দফতরে ঢুকবার চেষ্টা করে।

ইনজেগান ও অন্যান্য শহরে বিক্ষোভকারীরা পুলিশের গাড়ি পুড়িয়ে দেয়। ব্যাংক ও প্রশাসনিক ভবনগুলোতে আগুন দেয়। এমনকি সাধারণ নাগরিকদের গাড়ি ও অন্যান্য স্থাপনাও নষ্ট করতে দেখা যায়।

বুধবার সন্ধ্যার দিকে দেশটিকর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে যে এই আন্দোলনে নিরাপত্তা বাহিনীর ২৬৩ জন এবং ২৩ জন বেসামরিক নাগরিক আহত হয়েছে। এদিকে, বিশৃঙ্খলার অভিযোগে পুলিশ ৪০৯ জনকে আটক করে। তাদের মধ্যে ১৯৩ জনকে দাঙ্গা, হামলা ও লুণ্ঠনের অভিযোগে এবং নিরাপত্তা বাহিনীর উপর হামলার কারণে উচ্চ আদালতের কাছে পেশ করা হবে।

তবে প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তকে জোরালোভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন জেন-জি-২১২। তারা ঘোষণা দিয়েছে, শান্তিপূর্ণভাবে এই আন্দোলন চলবে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জানিয়েছে, এই আন্দোলনে অন্তত ১৪২টি গণপরিবহন ও ২০টি ব্যক্তিগত পরিবহন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

বিক্ষোভকারীদের দাবি কী?

বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভকারীরা যেসব দাবি উপস্থাপন করছে, তার সার-সংক্ষেপ হলো এই যে

-হাসপাতালের পরিবেশ ও স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নত করতে হবে। এমনিভাবে হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মী ও ওষুধ সরবরাহ করতে হবে। (দেশটির ২০২৪ সালের সরকারি হিসাব অনুযায়ী, দেশের মোট চিকিৎসকের সংখ্যা ১৫ হাজারের মতো। এর অর্থ হচ্ছে, দেশের প্রত্যেক ১০ হাজারের জন্য চারজন ডাক্তার। অথচ, আন্তর্জাতিকভাবে বলা হয়, ডাক্তারদের সংখ্যা প্রতি ১০ হাজারে অন্তত ১৫ জন থেকে ১৫ জন হওয়া উচিৎ।)

-শিক্ষাব্যবস্থা সংশোধন করতে হবে। একইসাথে শিক্ষার মান এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশ ও ব্যবস্থাপনা সুন্দর করতে হবে।

-সামাজিক সাম্য ও ন্যায়সঙ্গত বাজেট নিশ্চিত করতে হবে। একইসাথে বেকারত্ব দূরীকরণে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। (রাষ্ট্রীয় হিসাব অনুযায়ী, মরক্কোর মোট বেকারত্ব ১২.৮ শতাংশ। এরমধ্যে যুবকদের মাঝে বেকারত্বের পরিমাণ ৩৫.৮ শতাংশ। আর অন্যান্য এডুকেটেড পার্সনের বেকারত্বের পরিমাণ ১৯ শতাংশ।)

-দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে।

বিক্ষোভকারীদের সাথে কেমন আচরণ করছে সরকার?

প্রথম দিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় এসব আন্দোলন করতে নিষেধ করেছিল। তারা এটিকে অন্যায় ও অনুনোমোদিত আখ্যা দিয়েছিল। এ সময় তারা কয়েক ডজন বিক্ষোভকারীকে আটকও করে। তাদের অনেককে ইতোমধ্যে ছেড়ে দিয়েছে। আবার কতেককে হাইকোর্টে হাজির করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

অবশ্য কিছু কিছু শহরে নিরাপত্তা বাহিনী বিক্ষোভকারীদের সাথে কঠোর আচরণ করেছে। কোনো কোনো স্থানে উভয় পক্ষের মাঝে সংঘর্ষও হয়েছে।

চার দিন ধরে বিক্ষোভ চলার পরও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি। এরপর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় একটি বিবৃতি জারি করা হয়। সেখানে বলা হয়, সরকার জনগণের দাবিগুলো বুঝেছে এবং ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে প্রস্তুত। একইসাথে তারা যেকোনো স্থানে জেন-জির সাথে কথা বলতে প্রস্তুত। যেন উভয় পক্ষ মিলে দেশীয় ও নাগরিক সমস্যাগুলো সমাধানের কার্যকর উপায় বেরিয়ে আসে।

বিবৃতিতে আরো বলা হয়, এসব সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায় পারস্পরিক সংলাপ ও আলোচনা জারি রাখা।

আরো বলা হয়, সরকার স্বাস্থ্যখাতের এসব সঙ্কট গুরুত্বের সাথে নেবে। জেন-জির পক্ষ থেকে যেসব প্রস্তাবনা পেশ করা হয়েছে, সেগুলোকে অগ্রাধিকারভিত্তিতে বিবেচনা করবে।

বৃহস্পতিবার সরকার প্রধান আজিজ আখানুচ একটি বৈঠকের শুরুতে আবারো বলেছেন যে ‘মরক্কোর সকল সমস্যার সমাধানের একমাত্র উপায় পারস্পরিক সংলাপ জারি রাখা।’ এ সময় তিনি সামাজিক সমস্যাগুলোকে সমাধান করা হবে মর্মে ঘোষণাও দেন।

সূত্র : আল জাজিরা