পারমাণবিক বোমা তৈরির সক্ষমতা রাখে যেসব দেশ

শেষ কথা হলো, পারমাণবিক প্রতিযোগিতা এড়াতে একটি বৈশ্বিক সমঝোতা অপরিহার্য।

নয়া দিগন্ত অনলাইন
পারমাণবিক বোমার ছবি
পারমাণবিক বোমার ছবি |আল জাজিরা

১৯৬০-এর দশকে জাতিসঙ্ঘের উদ্যোগে পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধে গৃহীত হয় পারমাণবিক অপ্রসারণ চুক্তি (এনপিটি)। এতে স্থায়ী নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ সদস্য দেশের (যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য) পারমাণবিক অস্ত্রাধিকারকে স্বীকৃতি দেয়া হয়। আর অন্যদের পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনে নিরুৎসাহিত করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্রদের পারমাণবিক সহায়তার নিরাপত্তা দিয়ে চুক্তির কার্যকারিতা নিশ্চিত করে। তথাপি আজ বিশ্বের পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশের সংখ্যা নয়টি। কারণ, ইসরাইল, ভারত ও পাকিস্তান ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি। আর উত্তর কোরিয়া স্বাক্ষর করে ২০০৩ সালে তা থেকে বেরিয়ে ২০০৬ সালে পারমাণবিক পরীক্ষা চালায়।

ফেডারেশন অফ আমেরিকান সাইনটিস্ট (এফএএস)-এর বিশেষজ্ঞদের মতে, ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা, মার্কিন নিরাপত্তা গ্যারান্টির প্রতি আস্থার সঙ্কট এবং শক্তিধর দেশগুলোর (যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল) অ-পারমাণবিক রাষ্ট্রের ওপর আক্রমণ পারমাণবিক বিস্তারের সম্ভাবনা বাড়াচ্ছে। তারা আশঙ্কা করছেন, আগামী দুই দশকে পারমাণবিক রাষ্ট্রের সংখ্যা দ্বিগুণ হতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, ইরানের ওপর সাম্প্রতিক মার্কিন হামলা তাদের কর্মসূচিকে ত্বরান্বিত করতে পারে। একইভাবে, রাশিয়া ও চীনের উচ্চাকাঙ্ক্ষাও পরিস্থিতিকে অনিশ্চিত করছে।

‘নতুন পারমাণবিক যুগ’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে তিনটি অক্ষকে চিহ্নিত করা হয়েছে, যারা পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের পথে অগ্রসর হতে পারে। গ্রুপত্রয় হলো,

-মার্কিন মিত্র ইউরোপ ও এশিয়ার কিছু দেশ। যেমন পোল্যান্ড, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ান, যারা প্রযুক্তি ও সম্পদে পরমাণু অস্ত্র অর্জনে সক্ষম।

-মধ্যপ্রাচ্য : যারা ইরানের উচ্চাকাঙ্ক্ষা দেখে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনে উৎসাহিত হতে পারে।

-প্রতিবেশী দেশ :যারা পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশীর হুমকিতে নিজেদের অস্ত্রায়ন করতে পারে।

তবে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের পথ কঠিন ও ব্যয়বহুল। অত্যন্ত সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম বা প্লুটোনিয়াম সংগ্রহ, প্রযুক্তি, অর্থ এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ সবকিছু মিলিয়ে এ পথে রয়েছে বড় রাজনৈতিক ও সামরিক ঝুঁকি। তা সত্ত্বেও, বিশ্ব এখন পারমাণবিক বিস্তারের এক নতুন বিপজ্জনক যুগের দ্বারপ্রান্তে।

সীমাবদ্ধ পারমাণবিক রাষ্ট্র : দক্ষিণ কোরিয়া ও ইরানের অবস্থান

যেসব দেশ প্রযুক্তিগতভাবে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে সক্ষম কিন্তু এখনো তা তৈরি করেনি এবং আন্তর্জাতিক চুক্তির প্রতি আনুগত্য দেখাচ্ছে, তাদের ‘সীমাবদ্ধ পারমাণবিক রাষ্ট্র’ বলা হয়। এসব দেশ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিলে দ্রুত পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে পারবে।

দক্ষিণ কোরিয়া

দক্ষিণ কোরিয়া বিশ্বের অন্যতম উন্নত শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচি ও শিল্প ভিত্তি গড়ে তুলেছে। ১৯৭০-এর দশকে তারা গোপনে পারমাণবিক কর্মসূচি শুরু করলেও মার্কিন চাপে তা বন্ধ করে ১৯৭৫ সালে এনপিটিতে যোগ দেয়। তবে ২০০০-এর দশকের শুরুর দিকে কিছু গোপন প্লুটোনিয়াম ও ইউরেনিয়াম গবেষণা তাদের মৌলিক সামর্থ্য প্রকাশ করে।

উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক হুমকি দক্ষিণ কোরিয়ায় স্বতন্ত্র পারমাণবিক প্রতিরোধের প্রতি জনমত বাড়াচ্ছে। জরিপে দেখা যায় ৭০-৭৫ শতাংশ নাগরিক তা সমর্থন করে। ২০২৩ সালে প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইওলের একটি বক্তব্য এই বিতর্ককে আরো উস্কে দেয়। তিনি বলেছিলেন, সিউল চাইলে ‘খুব দ্রুত’ পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে পারবে। যদিও পরে সরকার এই বক্তব্য লঘু করে দেয়।

তবে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করলে দক্ষিণ কোরিয়া আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা ও কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতার ঝুঁকিতে পড়বে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে জোটও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এজন্য তারা এখনো মার্কিন নিরাপত্তা গ্যারান্টির ওপর নির্ভর করে চলছে।

ইরান

ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ১৯৭০-এর দশকে মার্কিন সহায়তায় শুরু হলেও ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পর তা বন্ধ হয়ে যায়। তবে সাম্প্রতিক ইসরাইলি ও মার্কিন নাশকতা ও হামলার মুখে তেহরান এখন পারমাণবিক অস্ত্রের পথে এগোবে কিনা, সেই সিদ্ধান্তের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। বিশ্বাস করা হয় যে ইরানের প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি ও সম্পদ ইতিমধ্যেই সংগ্রহ করা হয়েছে।

১৯৮০-এর দশকে ইরাকের সাথে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর আয়াতুল্লাহ খামেনি পারমাণবিক প্রযুক্তির মূল্য পুনর্বিবেচনা করেন এবং ইরান পাকিস্তানের দিকে নজর দেয়, যেখান থেকে বিজ্ঞানী আব্দুল কাদির খান সেন্ট্রিফিউজ বিক্রি করেন। ২০০০-এর দশকে আন্তর্জাতিক পরিদর্শকরা উচ্চ-গতির সেন্ট্রিফিউজে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ শনাক্ত করেন, যা এনপিটি চুক্তির লঙ্ঘন ছিল। এর ফলে জাতিসঙ্ঘ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং ২০১৫ সালে জেসিপিওএ স্বাক্ষরিত হয়। তবে ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র একতরফাভাবে চুক্তি থেকে সরে গেলে ইরান কর্মসূচি সম্প্রসারণ করে। অনুমান করা হচ্ছে, ২০২৪ সালের নভেম্বরে ইরান ‘ব্রেকআউট’ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। অর্থাৎ কয়েক দিনের মধ্যে একটি বোমার জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান প্রস্তুত করতে তারা সক্ষম।

২০২৫ সালের জুনে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনায় বিমান হামলা চালায়, যেমন নাতানজ, ফোরদো ও ইসফাহান। মার্কিন কর্মকর্তারা দাবি করেন, এতে উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হয়েছে। তবে গোয়েন্দা তথ্য বলছে, ইরান আগেই কিছু সেন্ট্রিফিউজ ও সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম সরিয়ে রেখেছিল। ফলে কয়েক মাসের মধ্যেই ক্ষতি পূরণ সম্ভব।

ইরান উন্নত সেন্ট্রিফিউজ পরিচালনার জ্ঞান রাখে। ইতোমধ্যে ৬০ শতাংশ সমৃদ্ধকরণে পৌঁছেছে। প্রয়োজনে পুনরায় মজুদ ও কার্যক্রম পুনর্গঠন করতে পারে। এই দক্ষতার কারণেই ইসরাইল ইরানি বিজ্ঞানীদের লক্ষ্যবস্তু করেছে।

ইরান এখনো পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি না করলেও তার বিজ্ঞান, শিল্প এবং ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতা রয়ে গেছে, যা ভবিষ্যতে অস্ত্র নির্মাণ সম্ভব করে তোলে।

জাপানের মতো ইরানও এখন ‘সীমাবদ্ধ পারমাণবিক রাষ্ট্র’, যা অস্ত্র না থাকলেও তা তৈরি করার সক্ষমতা রাখে।

জাপান : একটি সুপ্ত পারমাণবিক ক্ষমতার বাস্তবতা

পারমাণবিক হামলার শিকার একমাত্র দেশ হিসেবে জাপান কঠোর পারমাণবিক বিরোধী নীতি অনুসরণ করে এবং মার্কিন পারমাণবিক সহায়তার উপর নির্ভর করে। সংবিধান যুদ্ধ প্রত্যাখ্যান করে এবং পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি, ধারণ বা উপস্থিতির অনুমতি দেয় না।

তবুও জাপানের উন্নত বেসামরিক পারমাণবিক অবকাঠামো সমৃদ্ধকরণ ও পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ সুবিধা এবং ৪৬.১ টন প্লুটোনিয়ামের মজুদ তাকে একটি সম্ভাব্য পারমাণবিক রাষ্ট্রে পরিণত করে। এটি পারমাণবিক হেজিং কৌশলেরও একটি উদাহরণ, যেখানে অস্ত্র তৈরি না করেই তাৎক্ষণিক সক্ষমতা বজায় রাখা হয়।

চীনের পরমাণু শক্তির সম্প্রসারণ ও উত্তর কোরিয়ার বারবার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার কারণে টোকিওর নিরাপত্তা উদ্বেগ বেড়েছে। যদিও জাপান এখনো আমেরিকার নিরাপত্তা প্রতিশ্রুতির উপর আস্থা রাখছে, ভবিষ্যতে পরিস্থিতি পাল্টে গেলে সে তার পারমাণবিক অবস্থান পুনর্বিবেচনা করতে পারে।

শেষ কথা হলো, পারমাণবিক প্রতিযোগিতা এড়াতে একটি বৈশ্বিক সমঝোতা অপরিহার্য। কারণ বিস্তারের মূল প্রণোদনা আসে অপর পক্ষের শক্তি অর্জনের আশঙ্কা থেকে। অতীতে আমরা পারমাণবিক বিপর্যয় এড়াতে পেরেছি। কিন্তু ভবিষ্যতের ঝুঁকি এখনও বিদ্যমান।

সূত্র : আল জাজিরা