মুসলিমা খাতুন
সদরঘাট ঢাকার একটি ব্যস্ততম নদীবন্দর। ঊনিশ শতকে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে এই বন্দরকে ঘিরে ব্যবসায়িক জনপদ গড়ে ওঠে। এই নদীর পাড়েই রয়েছে বই প্রকাশনার কেন্দ্রবিন্দু বাংলাবাজার, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, আহসান মঞ্জিল ও ইসলামপুর কাপড়ের মার্কেট। এছাড়া মাছ ও ফলের বিশাল সব আড়ত রয়েছে এখানে।
সদরঘাট এমন একটি স্থান যেখানে মানুষ দিন-রাত কর্মব্যস্ত থাকে। তাই লোকমুখে প্রচলিত আছে সদরঘাট কখনো ঘুমায় না। এখানে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ আসা-যাওয়া করে। সদরঘাট শুধু যাত্রীবাহী লঞ্চ টার্মিনাল নয়, বরং একটি বিশাল কর্মক্ষেত্র।

শত পেশার মানুষের মিলনমেলা
এখানে শত পেশার মানুষের দেখা মেলে। ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে প্রায় সকল পেশার মানুষের সমাগম হয় এখানে। কেউ আছেন জাহাজ চালক, কেউ লোডার, আবার কেউ আছেন ব্যবসায়ী। এখানে দিনমজুর, রিক্সাচালক, ভ্যানচালক ও অন্যান্য পরিবহন শ্রমিকদেরও দেখা যায়। সদরঘাটের পাশে বিভিন্ন ধরনের দোকান, হোটেল, রেস্তোরাঁ ও ভাসমান ব্যবসায়ীরাও রয়েছে। এমনকি মুচি, ভিক্ষুক, ফেরিওয়ালা, হকার, পান বিক্রেতা, ফুল বিক্রেতা - এদেরও দেখা যায়। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এখানে বিরামহীন কর্মব্যস্ততা চলে।

নৌযান সংক্রান্ত পেশা
সদরঘাটে নৌযান সংক্রান্ত বিভিন্ন ধরনের পেশার মানুষ রয়েছে। লঞ্চে চালক, ইঞ্জিনম্যান, মেকানিক, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, নিরাপত্তাকর্মী, কেবিন বয় ইত্যাদি পেশার মানুষ রয়েছে। সুকানিরা নোঙর ফেলা, দড়ি বাঁধা ও লঞ্চের নোঙর তোলার কাজ করেন। হেলপার ও লস্কররা যাত্রী ওঠানামা ও মালামাল তুলতে সাহায্য করে। এছাড়া বাবুর্চি ও রান্নাঘরের কর্মীরা লঞ্চের যাত্রী ও কর্মীদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করেন।
পণ্যবাহী ট্রলার ও কার্গো জাহাজে কাজ করেন ডক শ্রমিকরা। এরা মাল তোলা-নামানোর কাজ সামলান। কিছু লঞ্চে ছোটখাটো দোকান বা চা-নাস্তার দোকানও থাকে। সদরঘাটের পাশে অসংখ্য নৌকা দেখা যায়। নৌকাতে যাত্রীরা খুব অল্প সময়ে নদী পার হতে পারে। এছাড়া নৌকায় বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করায় ভাসমান বাজার গড়ে উঠেছে। ছোট নৌকায় কৃষি পণ্য, মাছ, ফল, কাঠ, তৈরি মালপত্র নদীর এক ঘাট থেকে অন্য ঘাটে স্থানান্তর করা হয়।

ছোট-বড় ব্যবসায়ী
সদরঘাটে ছোট-বড় বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায়ী রয়েছে। পাইকারি ও খুচরা ব্যবসার জন্য এই এলাকা বিখ্যাত। এখানে মুদি দোকান, কাপড়ের দোকান, ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রীর দোকান, মাছ, ফলসহ বিভিন্ন খাদ্য সামগ্রীর দোকান ও অন্যান্য ব্যবসা রয়েছে। বড় ব্যবসায়ীরা সদরঘাটের অর্থনীতির মেরুদণ্ড।
এখানে কিছু ছোটখাটো ব্যবসাও রয়েছে। যেমন: ফেরিওয়ালা, হকার, চা- সিগারেটের দোকান, বাদাম বিক্রেতা, পান ও ঝালমুড়ি বিক্রেতা। এছাড়া ভাসমান বাজারে তাজা সবজি, ফল, মাছ ইত্যাদি প্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয়-বিক্রয় হয়। এখানে পুরুষের পাশাপাশি নারীদেরও দেখা যায়। নারীরা ফুল, ফল, সবজি ও হাতে তৈরি সামগ্রী বিক্রি করেন।
স্থানীয় ফল বিক্রেতা আব্দুর রহমান বলেন, ‘সদরঘাটে আমাদের ফলের ব্যবসা প্রায় ৬০ বছরের। আমার বাবা এ ব্যবসা শুরু করেছিলেন।’
ব্যবসায়ী রুবি খাতুন জানান, তিনি এখানে কয়েক মাস ধরে হাতের রিং বিক্রি করেন। রাত ৯টা পর্যন্ত সদরঘাটেই থাকেন।
পরিবহন শ্রমিক
সকাল থেকেই যাত্রীদের লঞ্চঘাটে পৌঁছে দিতে পরিবহন শ্রমিকরা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। যাত্রীরা লঞ্চ থেকে নেমে সড়কপথে ছড়িয়ে পড়েন। সবচেয়ে বেশি ব্যস্ততা থাকে সকাল ও সন্ধ্যায়। বাস, মিনিবাস, অটোরিকশা, সিএনজি ও রিকশা চালকদের এখানে দেখা যায়। এছাড়া বড় বড় ট্রাক ও টেম্পো সদরঘাট থেকে পণ্য সরবরাহের কাজ করে।
রিক্সাচালক করিম হোসেন বলেন, ‘সদরঘাটে সবসময় মানুষ চলাচল করে। এখানে সহজেই যাত্রী পাওয়া যায়। প্রতিদিন সকালে আমি এখানে আসি।’

অন্যান্য পেশা
সদরঘাটে মুচি থেকে শুরু করে ভিক্ষুক, নাপিতসহ ফটোগ্রাফারদেরও দেখা যায়। এখানে টুরিস্ট গাইডরাও আসেন পর্যটকদের নিয়ে।
দিনের শুরু থেকে রাত অবধি সদরঘাট যেন শত পেশার মানুষের মিলনমেলা। এখানে মানুষ একসাথে দিনরাত পরিশ্রম করে। তবে যানজট, অপরিচ্ছন্নতা, অপরিকল্পিত স্থাপনা, নিরাপত্তাহীনতা, চাঁদাবাজি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য এ অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়ন প্রয়োজন।
লেখক : নয়া দিগন্তের ইন্টার্ন শিক্ষার্থী।