রাজিয়া খাতুন
জেটচালিত বিমানে ভ্রমণ বর্তমানে যেন নিত্যদিনের ঘটনা। এর সূচনা হয়েছিলো মাত্র ৭৩ বছর আগে। ১৯৫২ সালে আকাশে উড়েছিল বিশ্বের প্রথম যাত্রীবাহী বাণিজ্যিক জেট বিমান ডি হ্যাভিল্যান্ড ডিএইচ ১০৬ কমেট। গতি, নিম্নশব্দ আর বিলাসিতায় এটি মুগ্ধ করেছিলো যাত্রীদের। তবে অল্প সময়ে এই জেট হয়ে ওঠে ভয়ংকর মৃত্যুফাঁদ। পর পর দুর্ঘটনার কারণে হারিয়ে যাওয়া বিলাসবহুল এই বিমানটি এখন নতুন রূপে ফিরেছে লন্ডনের উপকণ্ঠের এক জাদুঘরে।
জেট যুগের সূচনা
১৯৫২ সালের ২ মে বিকেল ৩টায় তৎকালীন লন্ডন বিমানবন্দর (বর্তমান হিথ্রো) থেকে উড্ডয়ন করে কমেট জি-এএলওয়াইপি। রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের শাষনামলে ব্রিটেন নির্মিত প্রথম বাণিজ্যিক এ জেট বিমানটি ২৩ ঘণ্টায় পাঁচটি যাত্রাবিরতি দিয়ে ৭ হাজার মাইল অতিক্রম করে পৌঁছায় দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে।
সেই সময়ের সেরা প্রপেলার বিমান লকহিড কনস্টেলেশনের তুলনায় কমেট ছিল দ্রুতগামী, শান্ত এবং ঝাঁকুনিহীন। এভাবে পৃথিবী হঠাৎ করেই প্রবেশ করেছিল জেট যুগে।

আকাশে প্রথম যাত্রীবাহী জেট উড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িংয়ের মতো প্রতিদ্বন্দ্বীদের হারিয়েছিল ব্রিটিশ বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ডি হ্যাভিল্যান্ড। কিন্তু সেই সুবিধা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। তাদের তৈরি প্রথম মডেল (কমেট ডিএইচ১০৬) অল্প সময়ের জন্যই শীর্ষে ছিলো। এরপর ধারাবাহিক দুর্ঘটনার ফলে পুরো বহরকে উড্ডয়ন থেকে বিরত রাখা হয়। সেগুলো হয় ধ্বংস করা হয় নয়তো অচল অবস্থায় ফেলে রাখা হয়।
জাদুঘরে যাত্রা
প্রথম কমেট বিমানে যাত্রার পর কেটে গেছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। সেই যাত্রার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল তা জানার একমাত্র উপায় ছিল সাদা-কালো ঝাপসা ফিল্মের ফুটেজ দেখা কিংবা রঙিন ছবিতে হাসিমুখে বসে থাকা পরিবারের দৃশ্য দেখা।
অন্তত কিছুদিন আগ পর্যন্ত আমাদের হাতে ছিল কেবল এই ছবিগুলোই। কিন্তু এখন একদল উৎসাহী মানুষ ধৈর্য আর যত্ন নিয়ে সেই অগ্রদূত জেট বিমানের একটি আবার জোড়া লাগিয়েছে। যার ফলাফল হয়েছে রোমাঞ্চকর।

দ্য ডি হ্যাভিল্যান্ড বিশ্বের সবচেয়ে কম পরিচিত বিমান যাদুঘরগুলোর একটি। এটি লন্ডনের উত্তর-পশ্চিমে সবুজ ফসলি জমি ও গ্রামীণ পরিবেশে অবস্থিত। কোলাহলপূর্ণ এম ২৫ হাইওয়ের কাছে এর অবস্থান। সাইনবোর্ড থাকলেও সরু গলিপথ দেখে মনে হবে যেন কোনো ফার্মহাউসে যাওয়ার রাস্তা।
পথে প্রথমেই চোখে পড়বে ঐতিহাসিক স্যালিসবারি হল। ১৬ শতকের একটি প্রাসাদ যা একসময় উইনস্টন চার্চিলের মায়ের বাসভবন ছিল। এরপর বাঁক ঘুরতেই উন্মোচিত হয় মিউজিয়াম, একটি মাঠ ভর্তি পুরনো বিমানের ধ্বংসাবশেষ ও সারি সারি হ্যাঙ্গার।

ডি হ্যাভিল্যান্ড বিমান যাদুঘর লন্ডনের উত্তর-পশ্চিমের গ্রামীণ এলাকায় অবস্থিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এখানেই তৈরি হয়েছিল কাঠের কাঠামোর যুদ্ধবিমান ডি হ্যাভিল্যান্ড মস্কিটো।
বর্তমানে মিউজিয়ামে রয়েছে সারি সারি পুরনো বিমানের ভগ্নাবশেষ। উজ্জ্বল হলুদ রঙের বিরল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন প্রোটোটাইপ মস্কিটো এবং ডিএইচ ১০০ ভ্যাম্পায়ার দেখা যায়। কিন্তু সবার নজর কাড়ে ডানাহীন বিশাল আকৃতির ডিএইচ ১০৬ ১এ কমেট।
নতুন প্রাণ পেল কমেট
১৯৮৫ সালে বিমানটি মিউজিয়ামে আসার সময় এটি ছিল ক্ষতিগ্রস্ত, ভেতর সম্পূর্ণ ফাঁকা। প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত এ কাঠামো বছরের পর বছর ধরে ধৈর্য নিয়ে পুনর্গঠন করেছেন মিউজিয়ামের স্বেচ্ছাসেবক প্রধান এডি ওয়ালশ ও তার দল।

স্বেচ্ছাসেবক দল ধীরে ধীরে এর অভ্যন্তরীণ কাঠামো পুনর্নির্মাণ করেছে। শুরুতেই রয়েছে আলাদা পুরুষ ও মহিলা টয়লেট। পুরুষদের জন্য ইউরিনাল, মহিলাদের জন্য চেয়ার, টেবিল ও আয়না।
এডি ওয়ালশ বলেন, এখনও এটি দারুণ সুন্দর বিমান।
কেবিনে রয়েছে প্রশস্ত ও আরামদায়ক জোড়া সিট যা নীল কাপড়ে মোড়া। জানালার পাশে লাল পর্দা। প্রতিটি সিটে অ্যাশট্রে। আছে বড় আকারের আয়তাকার জানালা। ওপরের দিকে লাগেজ বক্স ছিল না—লাইট ফিটিং ও কল বাটন থ্রিডি প্রিন্টারে বানানো হয়েছে।
প্রথম শ্রেণির অংশটিতে আছে মুখোমুখি দুটি জোড়া সিট। মাঝে কাঠের টেবিল যা পরিবারের জন্য একটি সুসজ্জিত ও নিঁখুত ব্যবস্থা।
ককপিটে দেখা যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞ পাইলটদের পরিচিত এনালগ ডায়াল ও সুইচ। নেভিগেটরের জন্য ছিল সেক্সট্যান্ট যার মাধ্যমে সূর্য ও তারার অবস্থান দেখে পথ নির্ধারণ করা হতো।
ওয়ালশ বলেন, এটি পুনর্গঠন করা ছিল প্রায় অসম্ভব কাজ।
বিলাসিতার ভেতর লুকানো বিপদ
প্রথম বাণিজ্যিক জেট বিমান ডি হ্যাভিল্যান্ড কমেট ছিলো খুবই বিলাসবহুল। খাবার পরিবেশন করা হতো ধাতব কাটলারি দিয়ে কাঠের ট্রেতে করে সিরামিক প্লেটে। যাত্রীদের পোশাক ছিল অভিজাত। ভাড়া ছিল আকাশছোঁয়া। জোহানেসবার্গ যাত্রার টিকিটের দাম ছিল ১৭৫ ব্রিটিশ ডলার যা বর্তমানে ৪,৪০০ ডলার (প্রায় ৬ হাজার মার্কিন ডলার)

দ্রুতগতির বিলাসবহুল এই বিমানটি দ্রুতই পরিণত হয়েছিল মৃত্যুফাঁদে। একের পর এক দুর্ঘটনায় থেমে গিয়েছিল এর জয়জয়কার।
১৯৫৩ সালের ৩ মার্চ কানাডিয়ান প্যাসিফিক এয়ারলাইন্সের কমেট দুর্ঘটনায় ১১ জন নিহত হয়। এরপর ভারতে দুর্ঘটনায় মারা যায় ৪৩ জন। ১৯৫৪ সালের জানুয়ারিতে ইতালির পথে মাঝআকাশে এক বিমান ভেঙে পড়ে নিহত হয় ৩৫ জন। এপ্রিলের আরেক দুর্ঘটনায় মারা যায় ২১ জন।
তদন্তে জানা যায়, উচ্চতা বারবার চাপ পরিবর্তনের ফলে ফিউজলাজে ফাটল ধরে যা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বিমানের দেয়াল ছিঁড়ে ফেলে।
শেষ এবং উত্তরাধিকার
পরবর্তীতে কমেটের উন্নত সংস্করণ বানানো হলেও তখন বোয়িং ৭০৭ ও ডগলাস ডিসি ৮ বাজার দখল করে নেয়। ফলে শেষ হয় ডি হ্যাভিল্যান্ডের বাণিজ্যিক উত্থান। কোম্পানি পরে হকার সিডলির হাতে যায়।
তবু কমেটের উত্তরাধিকার রয়ে গেছে। এর নকশা ও প্রযুক্তি পরবর্তী বিমানগুলোর নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
ওয়ালশ বলেন, কমেট হয়তো দুর্ঘটনার জন্য কুখ্যাত। কিন্তু এটি আসলে বিমান চলাচলের ইতিহাসে যুগান্তকারী উদ্ভাবন।
লেখক : নয়া দিগন্তের ইন্টার্ন শিক্ষার্থী।