বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত নান্দনিক কারুকার্য করা গোলাপি রঙের বাড়িটিই আহসান মঞ্জিল যা ঢাকার নবাবদের ঐতিহ্য ও আভিজাত্যের বহিঃপ্রকাশ। ব্রিটিশ আমলের স্থাপত্যগুলোর মধ্যে এটি এখনো টিকে আছে। ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে পাকিস্তান আমল পর্যন্ত বিভিন্ন ঐতিহাসিক সভা, রাজনৈতিক আলোচনা এখানে অনুষ্ঠিত হয়েছে। একসময় এ বাড়িটি ঢাকাসহ পুরো পূর্ববঙ্গেই প্রভাব বিস্তার করতো। ঢাকাবাসীর কাছে নবাববাড়ি হিসেবেই এটি বেশি পরিচিত ছিলো।

আহসান মঞ্জিল নির্মাণ করেন নওয়াব আবদুল গনি। তিনি তার পুত্র খাজা আহসানুল্লাহর নামানুসারে এর নামকরণ করেন। এর নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৮৫৯ সালে আর শেষ হয় ১৮৭২ সালে।
১৮৮৮ সালে প্রবল ভূমিকম্পে পুরো আহসান মঞ্জিলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ক্ষতিগ্রস্ত আহসান মঞ্জিল পুনঃনির্মাণের সময় বর্তমান উঁচু গম্বুজটি সংযোজন করা হয়েছে।
এরপর ১৮৯৭ সালে ১২ জুন ঢাকায় আবার ভূমিকম্প হলে আহসান মঞ্জিলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। তখন আহসান মঞ্জিলের দক্ষিণের বারান্দাসহ ইসলামপুর রোড সংলগ্ন নহবত খানাটি সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়ে।

পরবর্তীতে নবাব আহসানুল্লাহ তা পুনঃনির্মাণ করেন। ওই যুগে নবনির্মিত প্রাসাদ ভবনটি রংমহল ও পুরাতন ভবনটি অন্দরমহল নামে পরিচিত ছিল।
১৯০১ সালের আগে ঢাকায় কোন বৈদ্যুতিক বাতির ব্যবস্থা ছিল না। সন্ধ্যা নামলেই পুরো ঢাকা অন্ধকারে ছেয়ে যেতো। নওয়াব আহসানুল্লাহ ১৯০১ সালের ৭ ডিসেম্বরে আহসান মঞ্জিল ও আশেপাশের প্রধান সড়কে আলোর ব্যবস্থা করেন।
সে আমলে ঢাকা শহরে আহসান মঞ্জিলের মতো এতো আলোক সজ্জায় সজ্জিত ভবন আর ছিল না। উপরের গম্বুজটি শহরের অন্যতম উঁচু চূড়া হওয়ায় তা অনেক দূর থেকেও সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতো।
১৯৫২ সালে জমিদারী উচ্ছেদ আইনের মাধ্যমে ঢাকা নবাব এস্টেট সরকার দখল করে। কিন্তু নবাবদের আবাসিক ভবন আহসান মঞ্জিল এবং বাগানবাড়িসমূহ দখলে নেয় না।

একসময় অর্থাভাব ও নবাব পরিবারের প্রভাব প্রতিপত্তি কমে যাওয়ার ফলে আহসান মঞ্জিলের দেখাশোনা করা কষ্টকর হয়ে পড়ে। ১৯৬০’র দশকে এখানে থাকা মূল্যবান জিনিসপত্র নবাব পরিবারের সদস্যরা নিলামে কিনে নেয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর অযত্ন ও অবহেলায় এটি প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। এ অবস্থায় ১৯৭৪ সালে ঢাকা নবাব পরিবারের উত্তরসূরিরা আহসান মঞ্জিল প্রাসাদ নিলামে বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমান আহসান মঞ্জিলের স্থাপত্য সৌন্দর্য ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব উপলব্ধি করে ১৯৭৪ সালে এটি নিলামে বিক্রির প্রস্তাব নাতিল করে দেন। ১৯৮৫ সালের ৩ নভেম্বর আহসান মঞ্জিল প্রাসাদ ও তৎসংলগ্ন চত্বর সরকার অধিগ্রহণ করার মাধ্যমে সেখানে জাদুঘর তৈরির কাজ শুরু হয়। ১৯৯২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর আহসান মঞ্জিল জাদুঘরের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ও জনসাধারণের পরিদর্শনের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।
বর্তমানে ঢাকা শহরের অন্যতম একটা দর্শনীয় স্থান আহসান মঞ্জিল। প্রতিদিন দেশ-বিদেশের শত শত মানুষ ভীড় করে এটি দেখার জন্য। ছুটির দিনে একটু প্রশান্তির খুঁজে পরিবারের সদস্যদের বা বন্ধুদের সাথে চলে আসেন অনেকে।

প্রধান গেট দিয়ে প্রবেশ করলেই চোখে পড়বে বাগান। মূল ভবনের বাইরে ত্রি-তোরণবিশিষ্ট প্রবেশদ্বার দেখতে খুবই সুন্দর। একইভাবে উপরে ওঠার সিঁড়িগুলোও সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
মূল ভবনের ৩১টি কক্ষের ২৩টিতে প্রদর্শনী উপস্থাপন করা হয়েছে। আর ৯টি কক্ষ লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে প্রাপ্ত ও ফ্রিৎজকাপ কর্তৃক ১৯০৪ সালে তোলা আলোকচিত্রের সাথে মিলিয়ে সাজানো হয়েছে। এছাড়া ওই আলোকচিত্রের সাথে মিলিয়ে বিভিন্ন আসবাবপত্র তৈরি ও সমসাময়িককালের নিদর্শনের সাথে মিল রেখে নতুন পণ্য কিনে ও সংগ্রহ করে গ্যালারিতে উপস্থাপন করা হয়েছে। আহসান মঞ্জিল জাদুঘরে এখনো পর্যন্ত সংগৃহীত নিদর্শন সংখ্যা মোট চার হাজার ৭৭টি।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইয়াসিন পিয়াস বলে, 'এখানে ব্যবহৃত বিভিন্ন আসবাবপত্র, কারুকার্য, স্থাপত্যশৈলী আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের বড় নিদর্শন। এগুলো দেখার মাধ্যমে আমরা নবাব পরিবার সম্পর্কে বিভিন্ন বিষয় জানতে পারি।'

আহসান মঞ্জিলে পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসা দর্শনার্থী হামিদ বলেন, 'প্রায়ই ছুটির দিনে এখানে ঘুরতে আসি পরিবার নিয়ে। আমার বাচ্চাদেরও জায়গাটা খুব পছন্দ। তাছাড়া তারা ইতিহাস সম্পর্কেও অনেক কিছু জানতে পারে এখানে আসলে।'
বুড়িগঙ্গা নদী দূষণ যেন আহসান মঞ্জিলের সৌন্দর্যকে দিন দিন মলিন করে দিচ্ছে। তাছাড়াও এখানে আসার ভালো কোন রাস্তা নেই। ইসলামপুরের রাস্তাগুলোতে বেশিরভাগ সময়ই যানজট থাকে। ফলে দর্শনার্থীরা ভোগান্তির শিকার হয়।
অন্যদিকে আহসান মঞ্জিলের সামনের রাস্তায় স্তূপ করে রাখা হয় পাইকারি বাজারের ময়লা। দূষিত হয় পরিবেশ। এতে দর্শনার্থীদের পড়তে হয় বিড়ম্বনায়।
একসময় বুড়িগঙ্গা নদী থেকে আহসান মঞ্জিল দেখতে খুব সুন্দর লাগতো। কিন্তু এখন আর দেখা যায় না। বর্তমানে দেখা যায় অন্য চিত্র। আহসান মঞ্জিলের সামনে অনেকগুলো ফলের দোকান বসে। বেশিরভাগ সময় পঁচা ফলের দুর্গন্ধ ভেসে আসে। এগুলোর জন্য মানুষ এখানে আসার আগ্রহ হারাচ্ছে।
আহসান মঞ্জিলের সৌন্দর্য ধরে রাখতে হলে প্রথমে বুড়িগঙ্গা নদী দূষণ রোধ করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি প্রশাসনকেও সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
 


