কনক্রিটে মোড়া কর্মব্যস্ত জীবনের প্রশান্তি, শ্বাস-প্রশ্বাসের এক টুকরো সতেজ ফুসফুস পুরান ঢাকার ওয়ারী থানার শতবর্ষী বাগান ‘বলধা গার্ডেন’। সবুজ-শ্যামল গাছগাছালি, বেশ কয়েকটি চৌবাচ্চা আর সরোবর নিয়ে বিস্তৃত এ বাগানটি শুধু একটি উদ্ভিদের সংগ্রহশালা নয়, যেন ইতিহাস ও নান্দনিকতার অনন্য এক প্রতিচ্ছবি।
১৯০৯ সালে বলধা এস্টেটসের তৎকালীন বিশিষ্ট প্রকৃতিপ্রেমি নরেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী কর্তৃক বর্তমান পুরান ঢাকার ওয়ারীতে প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী ‘বলধা গার্ডেন’ মিরপুরস্থ জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের একটি স্যাটেলাইট ইউনিট। জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী ছিলেন একাধারে বৃক্ষপ্রেমি, সাহিত্যিক, প্রকৃতিবিদ। সেই গুণের আবিষ্টে অনুভূতিপ্রবণ হয়ে তিনি দু’টি অংশ নিয়ে গড়ে তোলেন উদ্ভিদ বাগানটি।

১৯৪৩ সালে জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী পরলোকগমন করার পর কোলকাতার হাইকোর্টের নিয়ন্ত্রণে ট্রাস্টের মাধ্যমে বাগানের দেখাশোনা করা হয় ৷ বাগানের কোনো উন্নতি না হওয়ায় বাগানের ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য ১৯৬২ সালে বলধা বাগানের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেয়া হয় বন বিভাগকে।
উদ্দেশ্য
শিক্ষার্থীদের শিক্ষা, গবেষণার কাজে সহায়তা এবং দর্শনার্থীদের জন্য প্রাকৃতিক শোভা উপভোগের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে গবেষণা, শিক্ষা ও উদ্ভিদের জিনপুল সংরক্ষণে বাগানটি সংরক্ষণ করা হয়। গবেষণার স্বার্থে ১৯০৯ সালেই সাইকী সেকশনে একটি গবেষণাগার স্থাপন করা হয়। বর্তমানে উদ্ভিদবিজ্ঞানী তাসলিমা খাতুন এবং গার্ডেন ইনচার্জ মান্নান সরকার গবেষণাগারটি দেখভাল করছেন।

বাগানের গঠন
বাগানটির আয়তন : ৩ দশমিক ৩৮ একর
অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ : ২৩ °৪৩ ০৬ ‘’N ৯০ °২৫ ’০৪ ‘’E
সেকশন : দু’টি, ‘সাইকী’ ও ‘সিবিলী’। ‘সাইকী’ অর্থ ‘আত্মা’ এবং ‘সিবিলী’ অর্থ ‘প্রকৃতির দেবী’ ৷ দু’টি শব্দই প্রাচীন গ্রীক পৌরানিক শব্দ।
দেশী-বিদেশী বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় ১৮ হাজার উদ্ভিদ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা আছে বলধা বাগানের ‘সাইকী’ ও ‘সিবিলী’ অংশে, যার প্রজাতির সংখ্যা ৮০০।
বাগানের বৈচিত্র্য
বলধা বাগানের ‘সিবিলী’ অংশের প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে শংখনদ পুকুর, ক্যামেলিয়া, স্বর্ণ আশোক, আফ্রিকান টিউলিপ, মহুয়া, চিকরাশিয়া, চাপালিশ, কোকোলোবা, মুচকুন্দ, নীল গোলমহর, সোনালু, হিজল, জারুল, তমাল, খয়ের, বিচিত্র বকুল, রুদ্রপলাশ, অর্জুন, সুরিনাম চেরী, নাগলিংগম, অশোক, টেবেবুইয়া, গুস্তাভা, উভারিয়া, আনকুরা/আঁকর কাঁটা, সুদ্ধ নারিকেল, রস কাউ, নাগেশ্বর, আগর, ওকনা, নীল মনিলতা, সাইকাস, বোতল পাম, উদয়পদ্ম/হিমচাঁপা, কর্ডিয়াসহ বিরল প্রজাতির গাছগাছালি।

আছে সূর্য ঘড়ি, জয় হাউজ ও ফার্ণ হাউজ ৷ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানকার জয় হাউজে বসে ক্যামেলিয়া ফুলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তার বিখ্যাত ক্যামেলিয়া কবিতাটি লেখেন।
‘সাইকী’ অংশের (এই অংশে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত) প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে লাল, নীল, সাদা, হলুদ জাতের শাপলায় ভরা অনেকগুলো শাপলা হাউজ, বিরল প্রজাতির দেশী-বিদেশী ক্যাকটাস, অর্কিড, এনথুরিয়াম, ভূজ্জপত্র গাছ, বিচিত্র বকুল, আমাজান লিলি ও কৃত্রিম সুড়ঙ্গসহ একটি ছায়াতরু ঘর।
দর্শনার্থীর আকর্ষণ বাড়াবে ‘জায়ান্ট ভিক্টোরিয়া ওয়াটার লিলি’ যার পাতাগুলো তিন থেকে চার ফুট পর্যন্ত চওড়া হতে পারে। অর্কিডের বিশাল সংগ্রহ, বনসাই এবং ক্যাকটাসের বিরল প্রজাতি, নানা রকমের ঔষধি উদ্ভিদ এবং কিছু বৃদ্ধপ্রায় শতবর্ষী বৃক্ষ।
বলধা গার্ডেনের উদ্ভিদ সংগ্রহে এমন কিছু উদ্ভিদ রয়েছে যেগুলোর উৎপত্তি দূর-দূরান্তের ভৌগোলিক অঞ্চলে। যেমন : ব্রাজিলের আমাজন বনের Giant water lily (Victoria amazonica), মধ্যপ্রাচ্যের ধূপ গাছ (Frankincense), চীনা বাঁশ, জাপানি ম্যাপল, ভারতবর্ষের নানান ধরনের ঔষধি গাছ (তুলসী, অর্জুন, আমলকি, অশ্বগন্ধা) প্রভৃতি।

দার্শনিক চিন্তা
নরেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরীর উদ্দেশ্য ছিল এমন একটি ‘জীবন্ত গ্রন্থাগার’ তৈরি করা যেখানে মানুষ প্রকৃতি থেকে শিখবে। বলধা গার্ডেন ছিল তার সেই স্বপ্নের প্রতিফলন। রায় চৌধুরী নিজে যা বিশ্বাস করতেন, তার লেখায়ও তাই ফুটে ওঠে। বাগানে বাঁধাই করা দু’টি ফলক তার মোক্ষম উদাহরণ। নিচে ফলক দু’টির লেখা তুলে ধরা হলো :
NRIPENDRA NARAYAN ROY CHOWDHURY
WE DON'T KNOW WHO RULES OUR DESTINY!
WHAT HIS LAWS-UN OLVABLE MYSTERY:
PURE AND AMIABLE SO BELOVED OF ALL:
LIGHT AND HOPE TO MY HEART AND SOUL:
CRUEL DESTINY TORE YOU AWAY FROM US:
AND LEFT US TO MOURN EVER WITH TEARS!
WISH YOU ETERNAL PROGRESS DIVINE SPIRIT:
WITH LOVE AND LIGHT IN TUNE WITH INFINITE:
BABA.
সত্যাৎ নাক্তি পবো ধর্ম্ম
‘‘জ্ঞানাৎ মুক্তি’’
I AM A PASSIONATE LOVER OF NATURE!
WITH ALL HER PHASES MY JOY FOR EVER!
LOVER OF ART. MUSIC AND LITERATURE!
OF HIGHEST HUMAN THOUGHTS ADORER!
PURE TRUTH, LOVE. DUTY AND DEVOTION,
I REVERE AS MY SOLE-HEART RELIGION!
SO VARIED A LIFE'S DRAMA
DROPPETH HERE ITS LAST CURTAIN!
I HAVE ENOUGH OF IT!
So, WISH ME NON-RETURN AGAIN!
WITH ALL THE BEST WISHES FOR THEE PASSER-BY
DROP ME A FLOWER! GOOD BYE!
SINCERELY YOURS
- N ROY:

জীববৈচিত্র্য
গাছপালার সাথে সাথে বলধা গার্ডেন নানা রকম পাখি, প্রজাপতি ও কীটপতঙ্গেরও আশ্রয়স্থল। এখানে প্রায়ই দেখা যায় কবুতর, ঘুঘু, দোয়েল, শালিক, টিয়া, রঙিন প্রজাপতি ও মৌমাছির ঝাঁক। ফলে এটি শুধু উদ্ভিদের বাগান নয়, বরং একটি ক্ষুদ্র ইকোসিস্টেম হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
সাংস্কৃতিক গুরুত্ব
শুধু উদ্ভিদ সংগ্রহ নয়, বলধা গার্ডেন নানাভাবে ঢাকার সাংস্কৃতিক ইতিহাসেরও অংশ। সাহিত্যিক, গবেষক ও প্রকৃতিপ্রেমীরা সময় কাটিয়েছেন এখানে। বিখ্যাত লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী, আহসান হাবীবসহ অনেকেই তাদের লেখায় এই বাগানের বর্ণনা দিয়েছেন।
বর্তমান অবস্থা ও রক্ষণাবেক্ষণ
দুঃখজনকভাবে, সময়ের সাথে সাথে বলধা গার্ডেনের রক্ষণাবেক্ষণে কিছুটা অবহেলা পরিলক্ষিত হয়। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের উদ্যোগে এখানে কিছু উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে। গার্ডেনকে আরো শিক্ষামূলক ও পর্যটনবান্ধব করার জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।

নিরাপত্তা-সতর্কতা
বলধা গার্ডেনে নিরাপত্তার জন্য নিয়োজিত নিরাপত্তা কর্মীরা দর্শনার্থীদের বিশেষ নিরাপত্তা দিয়ে থাকেন। বাগানের নিরাপত্তা ও অন্যান্য কাজের জন্য প্রায় ০৫ – ১০ জন লোক নিয়োজিত রয়েছে। বন বিভাগের হিসাব অনুযায়ী ১৩ জন লোক এখানে রয়েছেন। বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হবার সম্ভাবনা কম। তবে অল্প বয়সী ছেলে-মেয়েদের প্রবেশের কারণে সেখানে কর্তৃপক্ষ টহলের ব্যবস্থা রেখেছেন। গার্ডেনের ভেতর হকার প্রবেশ নিষেধ। গার্ডেনের বামদিকে দর্শনার্থীদের জন্য একটি টয়লেটের ব্যবস্থা আছে। যা ব্যবহার করলে ১০ টাকা দিতে হয়।
সময় ও টিকিট কাউন্টার
সকাল ৮টা থেকে বেলা সাড়ে ১২টা এবং দুপুর ২টা থেকে বিকেল সাড়ে ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে ‘বলধা গার্ডেন’। প্রতিদিনই খোলা থাকে সবার জন্য উন্মুক্ত গার্ডেনটি। মূল গেটের বাম পাশে একটি টিকিট কাউন্টার আছে। টিকিটের মূল্য ৩০ টাকা। পাঁচ বছর থেকে ১২ বছর বয়সীদের জন্য টিকিটের মূল্য ১৫ টাকা।
পরিবার ও বন্ধু-বান্ধবদের সাথে সময় কাটানো, প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ এবং যান্ত্রিক জীবনের স্ট্রেস দূর করতে ‘বলধা গার্ডেন’ হতে পারে প্রশান্ত দ্বীপ।