পুরান ঢাকাবাসীর গর্বের জায়গা ঐতিহ্যবাহী ধুপখোলা মাঠ

মাঠ কমপ্লেক্সের আয়তন প্রায় ৭.৪৭ একর। খেলাধুলা, শরীরচর্চা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ওয়াজ-মাহফিল এবং বিনোদনের জন্য মাঠটি ব্যবহৃত হয়।

তাসনীম মাহমুদ

Location :

Dhaka City
পুরান ঢাকা ধুপখোলা মাঠ
পুরান ঢাকা ধুপখোলা মাঠ |নয়া দিগন্ত

ঢাকার গেণ্ডারিয়া এলাকায় অবস্থিত ঐতিহাসিক ধুপখোলা মাঠ ঢাকা মহানগরীর অন্যতম বৃহৎ মাঠ। এ মাঠে পুরান ঢাকার বিভিন্ন থানার শিশু-কিশোর-যুবকরা খেলাধুলা করে। বয়স্করা করেন হাঁটাহাঁটি। এটি শুধু একটি খেলার মাঠ নয়; আশেপাশের এলাকার বাসিন্দাদের বন্ধুবান্ধব বা পরিবারের সাথে অবসর সময় কাটানোর জন্য জনপ্রিয় একটি পার্ক। এ মাঠে বাংলাদেশের জাতীয় দলের বেশকিছু খেলোয়াড় প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এখনও প্রতি বছর এই মাঠে জাতীয় পর্যায়ের খেলা হয়। বর্তমানে মাঠটি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন আওতাধীন সর্বসাধারণের খেলার মাঠ।

Dhupkhola-Math-07

মাঠটি ১৯৮৪ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ সর্বপ্রথম খেলাধুলার জন্য ঢাকা মহানগরী সিটি করপোরেশনের জন্য আওতাধীন করেন। মাঠ কমপ্লেক্সের আয়তন প্রায় ৭.৪৭ একর। খেলাধুলা, শরীরচর্চা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ওয়াজ-মাহফিল এবং বিনোদনের জন্য মাঠটি ব্যবহৃত হয়। এটি পুরান ঢাকার একটি ঐতিহ্যবাহী স্থান এবং স্থানীয় মানুষের কাছে গর্বের জায়গা।

Dhupkhola-Math-03

রোববার (১০ আগস্ট) বিকেলে ধুপখোলা বেড়াতে গেলে মাঠটির প্রাকৃতিক পরিবেশ আমাকে মুগ্ধ করে। ছেলে বেলায় ফিরে যেতে ইচ্ছে হলো। অনেকদিন পরে এমন খোলা পরিবেশে নিজেকে মেলে ধরতে মাঠের চারপাশ হেঁটে হেঁটে দেখতে থাকি। কংক্রিটের জঞ্জালে ভরা পুরান ঢাকায় এমন চমৎকার একটি খেলার মাঠ থাকতে পারে নিজ চোখে না দেখলে কল্পনা করা কঠিন।

মাঠটি মূলত তিন ভাগে বিভক্ত। মাঠের পশ্চিমাংশ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ। দক্ষিণ-পূর্বাংশ ইস্ট অ্যান্ড ক্লাবের এবং উত্তর-পূর্বাংশ সবার জন্য উন্মুক্ত খেলার মাঠ। তিনটি অংশের প্রত্যেকটি আকারে একেকটি ফুটবল মাঠের চেয়ে বড়।

Dhupkhola-Math-02

ধুপখোলার স্থানীয় বাসিন্দা ওবায়দুর রহমান কাজলের (৬৮) সাথে কথা বলে জানা যায়, ‘২০১৬ সালে মাঠে একটি বাণিজ্যিক শিশুপার্ক নির্মাণের উদ্যোগের প্রতিবাদে সভা-সমাবেশ ও মানববন্ধন করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। বাধ্য হয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন গণশুনানির আয়োজন করলে এলাকাবাসী বাণিজ্যিক আগ্রাসন থেকে মাঠটি রক্ষার পক্ষে অবস্থান নেন। গণদাবির মুখে বাণিজ্যিক শিশুপার্ক নির্মাণের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে ২০২৪ সালে মাঠটিতে গ্যালারিসহ খেলার মাঠ, সজ্জিত শিশু কর্নার, ভলিভল, হ্যান্ডবল খেলার জায়গাসহ মাঠের চারপাশে সকাল-সন্ধ্যা হাঁটার জন্য আলাদা রাস্তা ও বিশ্রামের জন্য বসার ব্যবস্থা করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ।’

তিনি বলেন, ‘মাঠে গরুর হাট বসতো। চারদিকের মার্কেট, বখাটে ও নেশাখোরদের উৎপাত মাঠের পরিবেশ নষ্ট করে তুলেছিল। পরিকল্পিত সংস্কার করায়, এসব বন্ধ হয়ে খুব সুন্দর পরিবেশ হয়েছে। ভোর থেকে রাত ৯টা থেকে ১০টা পর্যন্ত মাঠে হাঁটাহাঁটি করতে বা বসতে কোনো সমস্যা হয় না এখন।’

তিনি আরো বলেন, ‘ঐতিহ্যবাহী এই মাঠে বছরের দুই ঈদের জামাতে ৩০ থেকে ৪০ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করেন। বার্ষিক ওয়াজ-মাহফিল, ঘুড়ি উৎসবসহ বিভিন্ন উৎসবের মেলা হয় এখানে। তাছাড়া জানাযার নামাজও অনুষ্ঠিত হয় এই মাঠে।’

Dhupkhola-Math-05

স্থানীয় বাসিন্দা লোটন (৬১) বলেন, ‘ধুপখোলা মাঠের ইস্ট অ্যান্ড ক্লাবটি ১৮৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। মোহামেডান ক্লাব, রহমাতগঞ্জ ক্লাবসহ পুরাতন আরো দু’একটি ক্লাবের পরপরই এই ক্লাবটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে আজও সুনামের সাথে টিকে আছে। ক্লাবটির বর্তমান আহ্বায়ক মোরশেদ আহমেদ চৌধুরী এবং সদস্য সচিব আব্দুল কাদির। এ মাঠে বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান আমিনুল ইসলাম বুলবুল, মোহাম্মদ রফিক, মার্শাল আইয়ুবসহ জাতীয় পর্যায়ের অনেক খেলোয়াড় খেলাধুলা করেছেন। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এক হাজারেরও বেশি শিশু ও তরুণ এই মাঠে ক্রিকেট, ফুটবল, ভলিভলসহ বিভিন্ন ধরনের খেলা খেলেন। তিনটি ক্রিকেট ও দু’টি ফুটবল একাডেমিও রয়েছে এখানে।’

Dhupkhola-Math-06

ধুপখোলা মাঠের চারপাশ

মূল মাঠের চারপাশে বিভিন্ন গাছপালা বেষ্টিত কংক্রিটের হাঁটার রাস্তা ও বসার বেঞ্চ রয়েছে। মাঠের পশ্চিম পাশের রাস্তা লাগোয়া রয়েছে ঐতিহ্যবাহী ধুপখোলা বাজার ও মসজিদ। উত্তর পাশে রয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন আওতাধীন ধুপখোলা কমিউনিটি সেন্টার ও ১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠিত কুব্বাত আলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বিভিন্ন ধরণের টং দোকান। উত্তর-পূর্ব পাশে রয়েছে আজগর আলী হাসপাতাল। পূর্বে আনন্দ কুটির কমিউনিটি সেন্টার ও বিভিন্ন রকমের দোকানপাট। দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অবস্থিত বিখ্যাত ইস্ট অ্যান্ড ক্লাব। ক্লাবের সাথে ভলিভল ও হ্যান্ডবল খেলার নির্দিষ্ট জায়গা রয়েছে। রয়েছে চব্বিশের আন্দোলনে শহীদ, শহীদ জোনায়েদ চত্বর। দক্ষিণ পাশে রয়েছে মসজিদ, শিশুদের জন্য সাজানো গোছানো পার্ক, ওয়াসার বিশুদ্ধ খাবার পানির পাম্প, ও একটি পাবলিক টয়লেট। এছাড়াও দক্ষিণ পাশের বেজে বিকেল থেকেই দেখা মেলে হরেক রকমের ভাসমান ফাস্টফুড কর্ণার, যেখানে ভোজন রসিকরা সহজেই রসনা মেটাতে পারে।

পুরান ঢাকার গেণ্ডারিয়ার ঐতিহ্যের সাথে মিশে থাকা ধুপখোলা মাঠটি, এ অঞ্চলের শিশু-কিশোর-যুবক-বৃদ্ধ সবার বিনোদনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। এর চারপাশ বেষ্টিত শ্যামল বৃক্ষরাজি, মাঠের সবুজ ঘাসের দীর্ঘ লন, শিশু-কিশোর-যুবকদের খেলা ও আনন্দ-কোলাহল যে কারো ক্লান্তচিত্তকে আকৃষ্ট করবে- একটুখানি বিশ্রামে বসে প্রাকৃতিক পরিবেশে উন্মুক্ত আকাশ উপভোগের জন্য।