পথশিশুদের অনেকেই মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে

দেশে ৫৮ শতাংশ পথশিশু মাদকে আসক্ত। ১৪ শতাংশ শিশু ১০ বছরের আগেই মাদক সেবন করে। তুলনামূলকভাবে সহজলভ্য ও সস্তা হওয়ায় পথশিশুদের মধ্যে ৩১ দশমিক ৭ শতাংশ গাঁজা সেবন করে।

নয়া দিগন্ত অনলাইন
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি |ইউনিসেফ বাংলাদেশ

ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জ উপজেলার পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে বুড়িগঙ্গা নদী। নদীর বেড়িবাঁধের পাশেই একটি ছোট ছাউনি। এর মধ্যে বাস করে প্রায় ১০ থেকে ১৫ জন শিশু। সারাদিন তারা বিভিন্ন ধরনের ভাঙারি সংগ্রহ করে সন্ধ্যায় ফিরে আসে ছাউনিতে। তারপর প্রায় সবাই পলিথিন মুখে দিয়ে কিছু একটা করে।

এদের মধ্যে আসাদ নামে এক শিশুকে জিজ্ঞেস করা হলে সে জানায় ছোটবেলায় বন্ধুদের কাছ থেকে সিগারেট নিয়ে খেয়েছিল। তারপর গাঁজা আর ফেনসিডিল খেতে শুরু করে। এখন সে বলে, ‘ড্যান্ডি লইতে লইতে জীবনটা প্লাস্টিক হইয়া গেল।’ তখনই বোঝা গেল এটি এক ধরনের নেশা, আর এই নেশার নাম ‘ড্যান্ডি’।

সম্প্রতি ‘ড্যান্ডি’ নামে সহজলভ্য মাদকে আসক্ত হয়ে পড়েছে বেশিভাগ সুবিধাবঞ্চিত পথশিশু। ‘ড্যান্ডি’ এক ধরনের আঠা, যা মূলত সলিউশন নামে পরিচিত। এতে টলুইন নামে এক প্রকার উপাদান থাকে। টলুইন মাদকদ্রব্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। এটি সাধারণত জুতা তৈরি ও রিকশার টায়ার-টিউব লাগানোর কাজে ব্যবহার করা হয়।

এই আঠা পলিথিনের মধ্যে রেখে নিশ্বাস নিলে এক ধরনের নেশা হয়। এর ফলে ক্ষুধা ও শরীরের যন্ত্রণা কমে যায়। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এ নেশা শরীরের মারাত্মক ক্ষতি করে। মাদক গ্রহণের কারণে তাদের সুষ্ঠু বিকাশ ব্যাহত হয়, লেখাপড়ায় ক্ষতি হয় এবং সামাজিকীকরণে সমস্যা দেখা দেয়।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর কর্তৃক ২০২২ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে ৫৮ শতাংশ পথশিশু মাদকে আসক্ত। ১৪ শতাংশ শিশু ১০ বছরের আগেই মাদক সেবন করে। তুলনামূলকভাবে সহজলভ্য ও সস্তা হওয়ায় পথশিশুদের মধ্যে ৩১ দশমিক ৭ শতাংশ গাঁজা সেবন করে। ড্যান্ডিতে আসক্ত শিশুদের হার ১৫ দশমিক ২ শতাংশ।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতেই ড্যান্ডিতে আসক্ত পথশিশুর সংখ্যা প্রায় ৭৫ হাজার। শিশু-কিশোর ছাড়াও বাংলাদেশে প্রায় ৭ মিলিয়নের বেশি মানুষ কোনো না কোনোভাবে মাদকের সাথে যুক্ত। এদের মধ্যে ৮০ শতাংশ মাদকাসক্ত কিশোর ও তরুণ বয়সী মানুষ।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর কর্তৃক মে ২০২৫-এ প্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে, উত্তর-পূর্ব সীমান্তবর্তী জেলা এবং ত্রিপুরা সীমান্তসংলগ্ন জেলাগুলোতে ফেনসিডিলের চাহিদা সর্বোচ্চ। উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে মাদকের তেমন চাহিদা না থাকলেও বঙ্গোপসাগরতীরবর্তী জেলাগুলোতে ইয়াবার চাহিদা রয়েছে। রাজধানীসহ চট্টগ্রামে ইয়াবা, ফেনসিডিল এবং অন্যান্য মাদকের চাহিদা সীমান্তবর্তী এলাকার তুলনায় অনেক বেশি।

১৯৮৮ সাল থেকে প্রতি বছর ২৬ জুন আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবস (মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস) পালিত হয়ে আসছে। এ বছরে দিবসটির প্রতিপাদ্যে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে- মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা, মাদকের চোরাচালান ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করে ধীরে ধীরে বন্ধ করা। এ লক্ষ্যে মাদকবিরোধী গণসচেতনতামূলক কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। স্কুল, কলেজ, মাদরাসার পাঠ্যপুস্তকে মাদকবিরোধী শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি।

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন কিংবা পরিবার ও সমাজে নির্যাতিত ও লাঞ্ছিত শিশুরাই পরবর্তীতে মাদকের সাথে জড়িয়ে পড়ে। তাই মা-বাবার উচিত সন্তানদের সাথে মাদকের কুফল নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করা এবং বন্ধুসুলভ আচরণ করা। পাশাপাশি খেয়াল রাখতে হবে, সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কার সাথে মিশছে, ফেসবুক বা স্কুলের বন্ধু কারা। বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা জরুরি।

মাদকাসক্ত শিশুকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে পরিবারের সদস্যদের সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ করতে হবে। যাদের অভিভাবক নেই, তাদের সহায়তায় সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই আমাদের শিশুদের মাদকের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে। সূত্র : বাসস