একসময় গাছের ডাল কেঁপে উঠত ফাঁসিতে ঝুলে থাকা সিপাহিদের দেহের ভারে, বাতাসে ভাসত রক্তাক্ত ইতিহাসের আতঙ্ক। অথচ ইতিহাসের সেই রক্তাক্ত স্মৃতিকে বুকে নিয়ে উদ্যানটি আজ পরিণত হয়েছে শহরের মানুষের হাঁটার পথ, তরুণদের আড্ডার জায়গা আর বিনোদনের কেন্দ্রে। সময় যেন পাল্টে দিয়েছে ভয়াল মৃত্যুমঞ্চকে প্রাণবন্ত জীবনের উচ্ছ্বাসে।
বলছিলাম পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে অবস্থিত সেই ঐতিহাসিক বাহাদুর শাহ পার্কের কথা। স্থানীয়দের কাছে পার্কটি পরিচিত ‘আন্টাঘর’ নামে। আবার অনেকের কাছে এটি ভিক্টোরিয়া পার্ক নামেও পরিচিত।
বিভিন্ন সময়ে পার্কটির নাম পরিবর্তনের পিছনে রয়েছে নানান ইতিহাস। প্রতিটি নামের পিছনে লুকিয়ে আছে সে সময়কার শাসকদের বিনোদন, সংস্কৃতি, শক্তি প্রদর্শন, বিদ্রোহ, প্রতিরোধ, জাতীয়তাবাদী চেতনা।
আঠারো শতকের শেষের দিকে ঢাকার আর্মেনীয় সম্প্রদায় এখানে একটি বিলিয়ার্ড ক্লাব প্রতিষ্ঠা করে। স্থানীয়রা বিলিয়ার্ড বলকে ‘আণ্টা’ বলত, সেখান থেকেই জায়গাটির নাম হয় ‘আণ্টাঘর’। নবাব আবদুল গণি ও নবাব আহসান উল্লাহর পৃষ্ঠপোষকতায় এখানে বিলিয়ার্ড, টেনিস, ব্যাডমিন্টন খেলা হতো। আড্ডা, পার্টি ও বিনোদনের কেন্দ্র হয়ে ওঠে স্থানটি।

১৮৫৭ সালে মোঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের আমলে সংঘটিত সিপাহী বিদ্রোহ এ জায়গাটিকে নতুন ইতিহাস দেয়। ওই বছরের ২২ নভেম্বর লালবাগ কেল্লায় ইংরেজ মেরিন সেনারা আক্রমণ চালায়। দেশীয় সেনারা প্রতিরোধ গড়ে তুললে যুদ্ধ বেঁধে যায়। যুদ্ধ শেষে ইংরেজ সেনারা ১১ জন বিদ্রোহী সিপাহীকে আটক করে। প্রহসনমূলক বিচার শেষে তাদের দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। বিচারের পর সিপাহীদের আন্টাঘর ময়দানে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়া হয়। সেইসাথে বিদ্রোহ দমনে আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য তাদের লাশ দীর্ঘদিন গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়। ফলে এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে ভয় ও আতঙ্ক।
১৮৫৮ সালে রানি ভিক্টোরিয়ার শাসনভার গ্রহণের ঘোষণা এখান থেকেই পাঠ করা হয়। তখন এর নাম দেওয়া হয় ‘ভিক্টোরিয়া পার্ক’। পার্ক ঘিরে লোহার রেলিং বসানো হয়, চারপাশে রাখা হয় কামান। নবাব পরিবারের অর্থায়নে উন্নয়ন কাজ হয়। নবাব খাজা আহসানুল্লাহর ছেলে খাজা হাফিজুল্লাহর অকালমৃত্যুর পর ইংরেজরা তাঁর স্মরণে ১৮৮৪ সালে পার্কে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করে।
১৯৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের শতবর্ষে ‘ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট’ (ডিআইটি) এর উদ্যোগে এখানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। চার স্তম্ভের ওপর গম্বুজওয়ালা স্থাপনাটিই আজকের বাহাদুর শাহ পার্কের প্রতীক। এসময়ই বিদ্রোহের নেতৃত্বদানকারী শেষ মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের নামে এর নামকরণ করা হয় বাহাদুর শাহ পার্ক। আজও পার্কে বিদ্রোহীদের স্মরণে নির্মিত সেই স্মৃতিসৌধ ও রানি ভিক্টোরিয়ার স্মারক ওবেলিস্ক চোখে পড়ে।
পার্কটি ডিম্বাকৃতির, দুই পাশে ফটক রয়েছে, চারপাশে রয়েছে সরকারি-বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠান। সাতটি রাস্তার মিলনস্থলে দাঁড়িয়ে পার্ককে ঘিরে আছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, ঢাকা গভর্নমেন্ট মুসলিম হাই স্কুল, ইসলামিয়া হাই স্কুল, সেন্ট থমাস চার্চ ও ঢাকার প্রথম পানির ট্যাংক। আশেপাশের বাংলাবাজার, ইসলামপুর ও শাঁখারীবাজারের মতো গুরুত্বপূর্ণ এলাকাও এর সঙ্গে যুক্ত।

পার্কটিতে গেলে দেখা যায় নানান চিত্র। কেউ হাটাঁহাটি করছে, কেউ শুয়ে বা বসে বিশ্রাম নিচ্ছে, কেউবা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে। আবার রাতের বেলা জাল টাঙ্গিয়ে ক্রিকেট খেলতেও দেখা যায়। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সবসময় ই পার্কটিতে থাকে মানুষের ভিড়।
ইতিহাসের স্মৃতিচারণ করে প্রাতঃভ্রমণে আসা ইসমাইল হোসেন বলেন, যুগে যুগে ইতিহাস বদলেছে, তারপরও ইতিহাস ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে আজও দাড়িঁয়ে আছে পার্কটি। এটি পুরান ঢাকার সম্পদ। এটিকে রক্ষা করা এখানকার সবার দায়িত্ব।
পার্কের বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরে তিনি আরও বলেন, পার্কের বাহিরের চারপাশের ফুটপাতে অবৈধ দোকান আর বাস স্ট্যান্ড পার্কটির সৌন্দর্য নষ্ট করছে।
ছেলের অপেক্ষায় পার্কে বসে থাকা রত্না রানী দাস বলেন, ছেলেকে স্কুল থেকে নিতে এসেছি। স্কুল ছুটি হতে আরো কিছুটা দেরি হওয়ায় পার্কে বসে আছি। গাছের ছায়া আর বসার জায়গা থাকায় এই গরমেও একটু স্বস্তি পাওয়া যায় পার্কে আসলে। তবে বৃষ্টি হলে পার্কে থাকা যায় না, কোথাও কোনো ছাউনি না থাকায় বিড়ম্বনায় পড়তে হয়।
ঢাকা গভর্নমেন্ট মুসলিম হাই স্কুলের শিক্ষার্থী হাবিব বলেন, স্কুল ছুটি হলে বন্ধুদের সাথে পার্কে এসে আড্ডা দেই। আবার রাতে বন্ধুদের সাথে ক্রিকেট খেলি। পার্কটি আমাদের বিনোদনের একমাত্র জায়গা।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী রনি আহমেদ বলেন, পার্কের বাইরের অংশে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকায় বৃষ্টি হলেই পার্কের বাইরের পশ্চিম ও দক্ষিণ পাশের অংশে কয়েকদিন ধরে পানি জমে থাকে। আবার পার্কের ভিতরের ভ্রাম্যমাণ খাবারের দোকানগুলোর কারণে পার্কে ময়লা-আবর্জনা জমে পার্কটি নোংরা হয়ে যায়।

পার্কে ফুল বিক্রি করা ফজলু মিয়া বলেন, সকাল ৮ টা থেকে দুপুর পর্যন্ত এখানে ফুল বিক্রি করি। পার্কে নানা ধরনের লোকজন আসে। কেউ ব্যয়াম করে, কেউ শুয়ে-বসে থাকে, আবার স্কুল ছুটি হলে ছাত্র-ছাত্রীরা পার্কে এসে আড্ডা দেয়। অনেক বাবা-মা আসেন তাদের সন্তানদের স্কুল থেকে নেয়ার জন্য।
এছাড়া সরেজমিনে দেখা যায়, সদরঘাট দিয়ে লঞ্চে যাতায়াত করা অনেকেই পার্কে আসেন, বিশ্রাম নেন, সময় কাটান। আবার অনেকে কাজের ফাঁকে পার্কে এসে বিশ্রাম নেন।
ঢাকার নবাব পরিবারের ব্যক্তিগত অর্থায়ন পার্কের উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখে। স্থানীয়দের মতে এখানে একসময় গোলাপের বাগান, জবা ফুলের সারি আর জনসমাবেশে সাদাকালো টেলিভিশনে অনুষ্ঠান দেখার ইতিহাস ছিল। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়েছে অনেক কিছু। এখন পার্কে হকারদের আনাগোনা, ভাঙা রেলিং, নোংরা টয়লেট, অকেজো ফোয়ারা ও মাদকসেবীদের আড্ডা ঐতিহ্যকে ম্লান করছে।
আজও ভোরবেলায় প্রাতঃভ্রমণকারী, শিক্ষার্থী আর সাধারণ মানুষ ভিড় করেন এ পার্কে। ছুটির দিনে পরিবার নিয়ে আসেন দর্শনার্থীরা। সরকারি-বেসরকারি নানা অনুষ্ঠানও আয়োজন হয় এখানে। বাহাদুর শাহ পার্ক কেবল একটি পার্ক নয়, বরং উপমহাদেশের ঔপনিবেশিক ইতিহাস ও স্বাধীনতার চেতনার স্মারক।