ইসলামপুর

আরব্য ধাঁচের বাজার থেকে ঢাকার ব্যবসায়িক কেন্দ্রবিন্দু

আজ যেখানে হাজারো রঙিন কাপড়ের গাঁথুনি, সেখানেই ইতিহাসের পাতায় জ্বলজ্বলে নাম ইসলাম খান চিশতির। তিনি মুঘল আমলে বাংলার রাজধানী ঢাকায় আসেন, তার নামানুসারে এই জায়গার নাম হয় ইসলামপুর।

মুঘল আমলের ইসলামপুর
মুঘল আমলের ইসলামপুর |নয়া দিগন্ত

মেহেদী হাসান

রাজধানীর ইসলামপুরের প্রতিটি অলিগলি যেন ইতিহাসের সাক্ষী। মুঘল আমলে বুড়িগঙ্গার তীরে গড়ে ওঠা ইসলামপুর একসময় ছিল নবাবদের নৌ-পথের প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র। শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে এখন এটি দাঁড়িয়ে আছে ঢাকার সবচেয়ে ব্যস্ত ও কাপড়ের পাইকারি বাজার হিসেবে। এখানে পুরনো স্থাপত্য আর আধুনিক বাণিজ্যের এক অনন্য মেলবন্ধন ঘটেছে।

ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে দেখা যায়, নানা চড়াই উতরাই পার করে ইসলামপুর আরব্য ধাঁচের বাজার থেকে ঢাকার ব্যবসায়িক কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।

১৭’শ শতকের দিকে এখানে মসলিন, রেশম, চামড়া ও মৃৎশিল্পের বাণিজ্য চলতো। আরব বণিক থেকে শুরু করে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ এখানে ব্যবসার জন্য আসতেন। কালক্রমে এখানে বিভিন্ন ফলের ব্যবসাও হতো। ফলে একসময় এলাকাটি আমপট্টি নামে পরিচিত হয়ে উঠে।

কোম্পানি আমলে ১৭৭৩ সালের দিকে এখানে গড়ে ওঠে দেশের অন্যতম প্রাচীন পাইকারি কাপড় মার্কেট।

Islampur

আজ যেখানে হাজারো রঙিন কাপড়ের গাঁথুনি, সেখানেই ইতিহাসের পাতায় জ্বলজ্বলে নাম ইসলাম খান চিশতির। তিনি মুঘল আমলে বাংলার রাজধানী ঢাকায় আসেন, তার নামানুসারে এই জায়গার নাম হয় ইসলামপুর।

বাণিজ্য পরিসর

বর্তমানে ইসলামপুরে প্রায় ছয় হাজার পাঁচশ’ শোরুম ও প্রায় একশ’ মার্কেট আছে। ছোট-মাঝারি দোকানসহ দোকানের সংখ্যা দশ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে। যেখানে কর্মসংস্থান হয়েছে ৬০ থেকে ৭০ হাজার মানুষের। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাইকারি ক্রেতারা আসেন এখানে। রাজশাহী, চাঁদপুর, কুমিল্লা, বরিশাল, এমনকি চট্টগ্রাম থেকেও নিয়মিত পাইকারী ব্যবসায়ীরা আসেন ইসলামপুরে।

হামিদ ম্যানসনের ব্যবসায়ী আব্দুল হালিম বলেন, আমি এখানে ১৫ বছর ধরে ব্যবসা করছি। একসময় পাটের কাপড়ই ছিল মূল আকর্ষণ, এখন ভারতীয় থ্রি-পিস থেকে শুরু করে বিদেশি ফেব্রিক সবই পাওয়া যায়। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে পাইকারি ক্রেতারা এখানে আসেন।

বাজারের প্রতিটি গলি যেন একেকটা ফ্যাশনের ম্যাপ। কোথাও সিল্কের ঝলক, কোথাও ব্লক প্রিন্টের বাহার, আবার কোথাও কটন, লিনেন, জামদানি বনারসির নকশায় চোখ আটকে যায় ।

এখানকার ব্যবসায়ীরা জানান, প্রতিদিন এই বাজারে কয়েক শ’ কোটি টাকার কাপড়ের ব্যবসা হয়। তবে ঈদের সময় তা ছড়িয়ে যায় অনেকগুণ।

এই বাজার শুধু ব্যবসায় নয়, হাজারো মানুষের জীবনের চালিকাশক্তি। অনেক মানুষ প্রতিদিন দোকান খুলে দেন, কাপড় ভাঁজ করেন, গ্রাহকের ব্যাগ বইয়ে দেন, গুদামে কাজ করেন। সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত চলে তাদের ব্যস্ততা।

কেন ইসলামপুর অনন্য

রাজধানীর অন্যান্য বিপণি বিতানের তুলনায় এখানকার পণ্যের দাম তুলনামূলক কম। আর এই কারণেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পাইকারি ও খুচরা ক্রেতায় জমজমাট থাকে ইসলামপুর বাজার।

Islampur-02

দেশে নরসিংদীর বাবুরহাট, ভুলতা-গাউছিয়া বৃহৎ কাপড়ের বাজার হিসেবে পরিচিত। তবে কাপড়ের বৈচিত্র্য ও গুণগত মানের কারণে সারাদেশে ব্যবসায়ীদের কাছে ইসলামপুর মার্কেটের কদর বেশি।

পাইকারী ক্রেতা মুনির বলেন, আমি রাজশাহীর পবা থেকে বছরে কয়েকবার এখানে কাপড় কিনতে আসি। এখানে কাপড়ের বৈচিত্র্য, দামে কম আর মালের গুণগত মান ভালো। পরিবহনও সুবিধাজনক।

ইসলামপুরে বাহারি রঙের কাপড়ের মতোই রয়েছে বাহারি নামের মার্কেট

নওয়াববাড়ি গেট: সবচেয়ে বিখ্যাত পাইকারি কাপড় মার্কেট। অন্যতম মার্কেটগুলো হলো এসি মার্কেট, হামিদ ম্যানসন, চায়না মার্কেট, মনসুর ক্যাসেল, ইসলাম প্লাজা। এছাড়া জুবায়ের ম্যানসন, আহসান মঞ্জিল সুপার মার্কেট (চায়না মার্কেট), হোসেন মার্কেট, প্লাজা মার্কেট, গুলশান আরা সিটি।

এসব মার্কেটে মেলে দেশি-বিদেশি শার্ট, প্যান্ট, পাঞ্জাবি ও মহিলাদের জামার গজ কাপড়। ইসলামপুর এখন শুধুই একটি বাজার নয়, এটি একটি পূর্ণাঙ্গ ফ্যাশন হাব। যার শিকড়ে ইতিহাস আর ডালপালায় আধুনিকতার ছাপ।

Islampur-03

করোনাভাইরাস মহামারির পর থেকেই ইসলামপুর কিছুটা চাপে পড়ে। ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, যেখানে ঈদের সময় প্রায় হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হতো, এখন তা কমে গেছে।

এর মূল সমস্যা- ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস, আমদানি জটিলতা ও ব্যাংকের এলসি সংকট।

ছোট ব্যবসায়ীরা বলছেন, আগে দিনে ৫০ হাজার টাকার মাল বিক্রি করতাম। এখন ৫ হাজার টাকাও ওঠে না।

আজকের ইসলামপুর অনেকটাই বদলে গেছে, কিন্তু হারায়নি তার চরিত্র। এই চরিত্রে আছে মুঘল ছোঁয়া, ঐতিহ্যবাহী বাংলার কারিগরি শিল্প, আর নগর ঢাকার আধুনিক অর্থনীতি।

লেখক : নয়া দিগন্তের ইন্টার্ন শিক্ষার্থী।