মেহেদী হাসান
পুরান ঢাকার ইসলামপুরের নবাববাড়ি রোডে প্রায় ১৩৭ বছরের ঐতিহ্য বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক অনন্য জলাধার নবাববাড়ি পুকুর। এই পুকুর শুধু পানির উৎস নয়, বরং ইতিহাস ও বিনোদনের এক বিশেষ কেন্দ্র।
মৌলভি খাজা আবদুল্লাহ ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের মালিকানাধীন এ পুকুরটি স্থানীয়দের কাছে গোল তালাব নামেও পরিচিত। সরকারি গেজেটে এর নাম ইসলামপুরের গোল তালাব। স্থানীয়ভাবে পুকুরটি নবাব বাড়ি পুশকনি নামে পরিচিত। সাধারণত পুকুর চারকোনা হয়, কিন্তু এই পুকুরটি সম্পূর্ণ গোলাকার। যা ঢাকায় আর কোথাও নেই। পুকুরের চারপাশে রয়েছে নারিকেল গাছের সারি এবং নিরাপত্তার জন্য চার ফুট উঁচু লোহার বেষ্টনী।

ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী, ১৬১০ সালে নবাব আব্দুল বারি প্রথম এ জলাধার খনন করান। পরে ১৮৩০ সালে নবাব খাজা আলিম উল্লাহ কুঠিসহ পুকুরটি কিনে নেন ও সংস্কার করেন। ১৮৮৬ সালে পুনরায় খনন ও সংস্কার করে বর্তমান রূপ দেওয়া হয়। পুকুরের পাড়সহ আয়তন প্রায় আট বিঘা।
স্বাধীনতার পর পুকুরটির সৌন্দর্য নষ্ট হতে থাকে, মালিকানা নিয়ে দীর্ঘ মামলা চলে। শেষ পর্যন্ত ২০০৭ সালে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে মৌলভি খাজা আবদুল্লাহ ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট বৈধ মালিকানা পায়। বর্তমানে নবাব পরিবারের সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত নবাববাড়ি এ্যাংলিং কমিটি পুকুরটির পরিচালনা করছে।
পুকুরের পূর্বাংশে একটি ঘাট আছে। প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত খোলা থাকে। সকাল ও দুপুরে অনেক মানুষের গোসল করার অন্যতম স্থান এটি। গোসলের জন্য নেওয়া হয় পাঁচ টাকা। বিভিন্ন উৎসব ছাড়াও প্রতি মাসে যে কোনো দুই শুক্রবারে ছিপ দিয়ে মাছ ধরা হয় এখানে। মাছ ধরার জন্য পুকুর পাড়ে বাঁশ ও কাঠের প্রায় ২০টি মাচা বসানো আছে, যার টিকিটের দাম ৬ থেকে ১০ হাজার টাকা।
পুকুর ব্যবস্থাপনা কমিটির সূত্রে জানা যায়, মাছ ধরার মাচা থেকে যে টাকা আসে, তা পুকুরের রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের কাজে ব্যবহার করা হয়। আর গোসলের জন্য যে টাকা নেওয়া হয়, সেই টাকা জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করা হয়। পানি সবসময় পরিষ্কার রাখা হয়, যাতে মানুষ নিশ্চিন্তে গোসল করতে পারে। পানি কমে গেলে ওয়াসার পানি দেয়া হয়। সব সময় পরিষ্কার রাখার চেষ্টা করা হয় পুকুর পাড়।

পুকুর পাড়ের দোকানদার আব্দুল হালিম বলেন, আমি অনেক দিন ধরে এখানে দোকান করি। পুকুরটাকে কেন্দ্র করে আশপাশে দোকানপাট জমে উঠেছে। প্রতিদিন বহু মানুষ এখানে আসে। অনেকে গোসল করতে, মাছ ধরতে বা ঘুরতে আসে। এতে আমাদের ব্যবসাও ভালো হয়।
পুকুরের পানির সাথে ঢাকার কোনো ড্রেন বা বর্জ্য লাইন যুক্ত নেই। বৃষ্টিতে পানি বেড়ে গেলে তা নিষ্কাশন করা হয়, আর সংকট হলে ওয়াসার পানি দেওয়া হয়।
গোসল করতে আসা গোলাম হাবিব বলেন, ছোটবেলায় গ্রামে থাকায় পুকুরে গোসল করার অভ্যাস। তাই নিয়মিত এখানে গোসল করি। শহরের মধ্যে এত বড় পুকুর ও পরিষ্কার পানি পাওয়া দুষ্কর। মাত্র ৫ টাকা দিয়ে গোসল করা যায় এটা আসলেই স্বস্তির।
স্থানীয়দের মতে, নবাববাড়ি পুকুর শুধু একটি জলাধার নয়, এটি পুরান ঢাকার ঐতিহ্যের জীবন্ত স্মারক।
লেখক : নয়া দিগন্তের ইন্টার্ন শিক্ষার্থী।