ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গা নদী-দৈর্ঘ্যে ২৯ কিলোমিটার, রাজধানীর দক্ষিণ ও পশ্চিম অংশ ঘিরে বয়ে চলেছে। প্রতিদিন অসংখ্য নৌযানের চলাচলের কারণে এটি দেশের অন্যতম ব্যস্ততম নদী। বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, সদরঘাট বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ত নদী পারাপারের স্থানগুলোর মধ্যে একটি।
বুড়িগঙ্গার পূর্ব পাড়ের সদরঘাট ও পশ্চিম পাড়ের কেরানীগঞ্জকে যুক্ত করতে প্রতিদিন শত শত ডিঙ্গি নৌকা চলাচল করে। আর এই যোগাযোগ ব্যবস্থার মূল ভরসা হচ্ছেন নৌকার মাঝি। যারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ঢাকার সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও জীবনধারার অংশ হয়ে আছেন।

ঢাকার সদরঘাট, ওয়াইজঘাট, বাদামতলী ও শ্যামবাজারসহ বুড়িগঙ্গা নদীর তীরজুড়ে প্রতিদিন হাজারো মাঝি জীবিকার তাগিদে নৌকা চালান। স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এসব এলাকায় দেড় থেকে দুই হাজার মাঝি প্রতিদিন ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের কাজে ব্যস্ত থাকেন। নৌকাচালনার মাধ্যমে তাদের দৈনিক আয় গড়ে ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা হলেও, বাস্তবে হাতে পাওয়া অর্থ অনেক কমে যায়। কারণ ইজারা বাবদ প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা ঘাট কর্তৃপক্ষকে জমা দিতে হয়, নৌকা ভাড়া বা কিস্তি শোধ করতে হয়, নৌকার রক্ষণাবেক্ষণের খরচ বহন করতে হয় এবং ঘাটে সিরিয়াল পেতে আলাদা অর্থ খরচ হয়। ফলে নৌকাচালনার কষ্টকর পরিশ্রম সত্ত্বেও মাস শেষে তাদের হাতে খুব সামান্যই অর্থ থাকে।

বেশিরভাগ মাঝি পরিবার থেকে দূরে নৌকাতেই থাকেন। রান্না, খাওয়া ও গোসলের জন্য তারা নদীর ওপরই নির্ভরশীল, যদিও বুড়িগঙ্গার পানি শিল্পকারখানার বর্জ্য ও আবর্জনায় মারাত্মকভাবে দূষিত। দীর্ঘদিন এই পানির সংস্পর্শে থাকার ফলে ত্বকের রোগ, শ্বাসকষ্ট ও পানিবাহিত নানা রোগে তারা আক্রান্ত হচ্ছেন। তবে চিকিৎসার খরচ জোগানো তাদের পক্ষে কঠিন হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রেই তারা প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিতে পারেন না।
নদীর তীর দখল, অবৈধ স্থাপনা ও দূষণের কারণে নদীর প্রবাহ দিন দিন কমে যাচ্ছে, যা মাঝিদের কাজকর্ম ও আয়ে প্রভাব ফেলছে। শুষ্ক মৌসুমে নাব্যতা কমে যাওয়ায় অনেক সময় যাত্রা ব্যাহত হয়, আবার বর্ষায় স্রোতের তীব্রতায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়ে যায়। এছাড়া ডিজিটাল ব্যবস্থার প্রসার ও বিকল্প পরিবহনের কারণে যাত্রী কমে যাওয়াও মাঝিদের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এ অবস্থায় মাঝিদের অনেকেই পেশা বদলের কথা ভাবেন। কিন্তু তাদের বেশিরভাগেরই বিকল্প পুঁজি বা দক্ষতা নেই। ফলে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম তারা এই পেশায় যুক্ত থাকেন। নদীর প্রতি গভীর ভালোবাসা, স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ এবং অভ্যাসের কারণে তারা এই কষ্টের জীবন মেনে নিয়েছেন। তবে জীবনের প্রতিদিনের সংগ্রাম ও অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ তাদের মনে এক ধরনের স্থায়ী চাপ তৈরি করে রেখেছে।
জীবিকার টানাপোড়েন
বুড়িগঙ্গার মাঝিরা যাত্রী পারাপার, পণ্য পরিবহন ও মাছ ধরেই জীবিকা নির্বাহ করেন। সদরঘাট– কেরানীগঞ্জ রুটে প্রায় দুই হাজার মাঝি কাজ করেন। দৈনিক যাত্রী ভাড়া জনপ্রতি মাত্র ৫ টাকা, আর রিজার্ভ ভাড়া ২০ থেকে ৩০ টাকা। কিন্তু ঘাট চাঁদা ও নৌকা ভাড়া মিলিয়ে প্রতিদিন মালিককে দিতে হয় ১৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত। সারাদিনে ৪৫ থেকে ৫০ বার পারাপার করেও খরচ বাদে হাতে থাকে গড়ে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা।

মিডফোর্ডঘাটের মাঝি রুহুল আমিন বলেন, সম্প্রতি মিডফোর্ডের নদীর পাশের গেট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আগের চেয়ে যাত্রী কমে গেছে। আমাকে দৈনিক নৌকা ভাড়া বাবদ ১৩০ টাকা, ঘাটভাড়া বাবদ ১১০ টাকা দিতে হয়। এছাড়াও খাওয়া-দাওয়া বাবদ দৈনিক ১৫০ টাকা খরচ হয়। দিন শেষে অল্প কিছু টাকা হাতে থাকে। এভাবে ১০ থেকে ১৫ দিনের জমানো কিছু টাকা পরিবারের জন্য পাঠাই।
নতুন প্রতিযোগিতা ও যাত্রী সঙ্কট
ডিঙ্গি নৌকার সবচেয়ে বড় হুমকি এখন ইঞ্জিনচালিত নৌকা। স্থানীয় প্রভাবশালীরা ৩০০ থেকে ৪০০টি ইঞ্জিনচালিত নৌকা চালু করায় মাঝিদের যাত্রী কমে যাচ্ছে।

মাসুম আলী, যার বাবা-দাদাও মাঝি ছিলেন, বলেন- ‘আমার বাবা-দাদাও মাঝি ছিলেন। নদী ছাড়া আর কিছু জানি না। কিন্তু নদীও আগের মতো নেই-দূষণ, দখল আর আধুনিক জেটির কারণে যাত্রী কমে যাচ্ছে।’
২৬ বছরের মাঝি মোহাম্মদ জায়েদ জানান, মায়ের চিকিৎসার জন্য জমি বিক্রি করে ঢাকায় এসে এই পেশায় যোগ দিয়েছেন, কিন্তু আয় দিয়ে সংসার চালানোই কষ্টকর, চিকিৎসা বা পড়াশোনার সুযোগ নেই।
আলম মার্কেট ঘাটের মাঝি জাফর আলম বলেন, ‘আগে মসজিদ ঘাটে যাত্রী নামাতে পারতাম, তখন কষ্ট কম হতো। এখন সেটা বড় বড় লঞ্চ মালিকদের দখলে। তাই ওইখানে আমরা আর যাত্রী নামাতে পারি না, নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ফলে এখান থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ওয়াইজঘাটে গিয়ে যাত্রী নামাতে হয়। কিন্তু এর জন্য কোনো বাড়তি টাকা নেওয়া যায় না।’

প্রতিকূলতা ও ঝুঁকি
বৃষ্টি ও শীতের রাতে নৌকায় থাকা, দূষিত পানির দুর্গন্ধ, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং দুর্ঘটনার ঝুঁকি মাঝিদের জীবনকে আরও কঠিন করে তুলছে।
নাগরমহল ঘাটের মাঝি সবুর আলী বলেন, ‘শীতের রাতে নৌকায় থাকা খুব কষ্টের। দূষিত পানির দুর্গন্ধ আর ঠান্ডা বাতাসে ঘুম আসেই না।’
ওয়াইজঘাটের আক্কাস মাঝি বলেন- ‘শীতে ঠান্ডা আর বাতাসে নৌকা দুলতে থাকে, রাত কাটানো দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।’

মিডফোর্ডঘাটের মাঝি সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘বৃষ্টির দিনে নৌকা চালানো সবচেয়ে কষ্টকর। মাথার ওপর ঝুম বৃষ্টি, চারপাশে নদীর ঢেউ, শরীর ভিজে একাকার-তবুও যাত্রী নামাতে হয়। নৌকার ভেতরে পানি ঢুকে যায়, সেটা আবার বালতি দিয়ে ফেলে দিতে হয়। ঠাণ্ডায় হাত-পা জমে যায়, কিন্তু কাজ থামানো যায় না, না হলে সেদিনের ভাড়া আর খাওয়া জোটে না।’
নদীর অবস্থা ও পরিবেশ সংকট
একসময় ঢাকার প্রাণ ছিল বুড়িগঙ্গা, কিন্তু এখন এটি শিল্পবর্জ্য, জাহাজ নির্মাণের বর্জ্য ও অবৈধ স্থাপনার কারণে মারাত্মকভাবে দূষিত। নাব্যতা কমেছে, মাছ কমে গেছে, আর দূষিত পানি স্পর্শ করলে চর্মরোগের ঝুঁকি রয়েছে।
শেষ কথা
ঢাকার উন্নয়নের ভিড়ে বুড়িগঙ্গার বুকেই চলছে শত শত মাঝির অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। তাদের বৈঠার ছন্দে বেঁচে আছে নদী, আর নদীর স্রোত বয়ে নিয়ে চলে ঢাকার প্রাণ। মাঝিদের রক্ষা করতে না পারলে হারিয়ে যাবে ঢাকার এক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্য-যা শুধু পরিবহনের নয়, ইতিহাস ও সংস্কৃতিরও অংশ।