বাঁধনহারা বৃষ্টি ধারায় কী কথা কয় বর্ষার ফুলে

এসব ফুল বৃষ্টিস্নাত পরিবেশকে যেমন মোহনীয় করে তোলে; তেমনই তার রূপ-সুগন্ধ মোহিত করে আমাদের প্রাণ ও প্রকৃতিকে। মন ছুঁয়ে থাকে ভিন্নরকম এক প্রশান্তিতে।

হুমায়ুন কবীর, কলাপাড়া (পটুয়াখালী)
বর্ষার অপরূপ সৌন্দর্য কদম ফুল
বর্ষার অপরূপ সৌন্দর্য কদম ফুল |নয়া দিগন্ত

বর্ষা মানেই কদম ফুল। তাই বর্ষার শুরুতেই মিলবে কদমের সৌরভ। তবে এরই মাঝে টানা বৃষ্টির পরশে নতুন করে সেজে উঠেছে প্রকৃতি। বর্ষার নতুন পানিতে খাল-বিল ভরে উঠেছে। সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে সুগন্ধি সব ফুল।

গ্রামে গাছে গাছে ফুটে থাকা কদম ফুল বর্ষার প্রকৃতিতে এনে দেয় নজরকাড়া সৌন্দর্য। বর্ষায় ফোটা ফুলগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কদম, বকুল, স্পাইডার লিলি, দোলনচাঁপা, সুখদর্শন, ঘাসফুল, শাপলা, সন্ধ্যামালতি, কামিনী, গুলনার্গিস, দোপাটি ও অলকানন্দ, কেয়া, কামিনী, বেলি ও বকুলের সুবাসে এখন মুখরিত চারপাশ। কদম গাছ দীর্ঘাকৃতির ও বহু শাখাবিশিষ্ট।

কদম ফুলের আদি নিবাস ভারত, চীন ও মালয়। গ্রামাঞ্চলে নদীর তীরে, খোলা প্রান্তরে প্রচুর কদম গাছ চোখে পড়ে। শহরে দেখা মেলে পার্কে ও উদ্যানে। কদম গাছের ছোট ডালের আগায় গোল হয়ে কলি ও ফুল ফোটে।

বৃষ্টি হলো পৃথিবীর ভালোবাসার মতো। বৃষ্টিজলে স্নান করে পৃথিবীর মাটি সিক্ত হয়, ঋতুবতী হয়। আর সে মাটিতেই ফলে শস্য, ফোটে ফুল। বর্ষা মানেই মুখ গোমড়া কাজল-কালো আকাশ, থাকবে হঠাৎ হঠাৎ বৃষ্টি পড়ার শব্দ। আর বনে-বাগানে সুগন্ধে মাতোয়ারা করা ফুল। বর্ষা ঋতুর আগমনি গান বেজে ওঠে শাখায় শাখায় কদমফুলের উল্লাসে। কিন্তু এর পর থেকেই একে একে ফুটতে থাকে বর্ষার অনেক ফুল।

কাজল-কালো মেঘের পটভূমি আর বৃষ্টিকণার হীরকদ্যুতি এ সময় ফোটা সব ফুলের মধ্যে সাদা রঙের ফুলগুলোকে দেয় বিশেষ আসন। বর্ষার জলে সাদা ফুলেরা যেন সুগন্ধ আর শুভ্রতায় আরো বেশি পবিত্র হয়ে ওঠে। বর্ষায় যত ফুল ফোটে তার মধ্যে সাদা ফুলের সংখ্যাই বেশি।

সাদা ফুলেরা আবার ফোটে রাতে, তার সুগন্ধ বিলিয়ে জানান দেয় যে ওরা এসেছে। রাতে কেন এসব সাদা ফুলেরা ফোটে, সেটাও এক রহস্য! ওদের পরাগায়নের জন্য আকৃষ্ট করতে হয় পতঙ্গদের। রাতে রঙিন ফুলে পতঙ্গদের চোখ পড়ে না, যতটা ওরা দেখতে পায় সাদা ফুলদের। না দেখতে পেলেও ওদের ক্ষতি নেই। ওসব ফুলের সৌরভই পতঙ্গদের কাছে টেনে আনে। আর নিশাচর পতঙ্গেরা সেসব ফুলের পরাগায়ন ঘটায়।

বাংলা সনের হিসেব অনুযায়ী ষড়ঙ্গতুর এই দেশের প্রথম ঋতু গ্রীষ্মের বৈশাখ-জৈষ্ঠের খরতাপ, কালবৈশাখীর তাণ্ডবের নাগপাশ ঠেলে প্রকৃতিতে আসে বর্ষা ঋতু। আষাঢ়-শ্রাবণ; দুই মাসের এই ঋতুর রোদ, বৃষ্টি আর মেঘের শান্ত-স্নিগ্ধ খেলায় প্রকৃতিকে ধুয়ে, মুছে করে তোলে নির্মল-সবুজ, বুলিয়ে দেয় প্রশান্তির অনাবিল পরণ। উপহার দেয় মোহনীয় ঘ্রাণের, রঙের অসংখ্য বাহারি ফুল।

এসব ফুল বৃষ্টিস্নাত পরিবেশকে যেমন মোহনীয় করে তোলে; তেমনই তার রূপ-সুগন্ধ মোহিত করে আমাদের প্রাণ ও প্রকৃতিকে। মন ছুঁয়ে থাকে ভিন্নরকম এক প্রশান্তিতে।

রূপ-রস-গন্ধে শোভিত বর্ষা ঋতুতে ফোটা ফুল গুলো অন্য ঋতুর চেয়ে বেশ ভিন্ন। এই ঋতুতে লাল, নীল, বেগুনি, হলুদ, কমলা রঙসহ নানা রঙের ফুলের দেখা মিললেও সাদা রঙের ফুলের সংখ্যা যেমন বেশি, তেমনি অন্য রঙের। ফুলগুলোর মধ্যে অধিকাংশ ফুলেই সাদার উপস্থিতি লক্ষণীয়। বর্ষার মুখ গোমড়া কাজলকালো আকাশের কারণে কিংবা বৃষ্টিজলে ধুয়ে এসব সাদা ফুলের পবিত্রতা ও স্নিগ্ধতা বেড়ে যায় অনেক গুণে।

বর্ষাকালের ফুল হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত কদম। বর্ষার আগমনি গান বেজে ওঠার সাথে সাথে দেশের আনাচে-কানাচে কদম শাখায় ফুটে ওঠা এ ফুলকে ‘বর্ষার দূত’ হিসেবেই অভিহিত করা হয়। বনে-বাঁদাড়ে কিংবা বাগানে পূর্ণ প্রস্ফুটিত এ কদম ফুল বলের মতো গোল, মাংসল পুষ্পাধারে সরু সরু বিকীর্ণ বিন্যাসে হলুদ-সাদর আধিক্যে প্রচ্ছন্ন। ফুলের মঞ্জরি হলুদ আর বৃতি সাদা।

ভুবন মোহিত করা সুগন্ধি আর মোহনীয় রূপের কদম ফুলের সাথে সাথেই জলে টইটুম্বুর খালবিলে ফোটে সাদা, গাঢ় লাল, নীল ও গোলাপি রঙের শাপলা ফুল। চোখে পড়ে কয়েক রকমের শালুক-পদ্ম ফুলও। সবুজ পাতার ফাঁকে উঁকি দেয় বেগুনি রঙের কলমি ফুল। অপার নান্দনিকতায় চেয়ে থাকে বেগুনি রঙের সঙ্গে সাদার মিশ্রণের অনুপম সৌন্দর্যের কচুরিপানা ফুল।

বসতবাড়ি কিংবা অফিস-আদালতের বাগানে শোভা ছড়ায় দোলনচাঁপা, বেলি, কামিনী, মালতী, মুমি বা জুঁই, রজনিগন্ধা, সুদর্শন বা স্পাইডার লিলি, সাদা কাঠগোলাপ, সুগন্ধি বা অ্যারোমেটিক জুঁই, ক্রিমেটিস জুঁই, অলকানন্দা ও মেহেদি ফুলসহ প্রভৃতি ফুল। এদের সাথে সঙ্গ দেয় রঙের সাথে মিল রেখে নামকরণের শ্বেতচাঁপা, শ্বেত রঙ্গন, শ্বেতকাঞ্চন বা ঘণ্টা ফুলের সৌন্দর্য। বাড়ির ছাদে কিংবা বাগানে লাল রঙের রেড লিলিও মিষ্টি সুগন্ধির সঙ্গে ছড়ায় অনন্য শোভা।

এ ঋতুর গাঢ় রঙের রঙিন ফুলের ভিড়ে দেখা মিলবে টাইগার লিলি, রেইন লিলি, বহুরঙা গেন্ডারি লিলি, মর্নিং গেন্ডারি ফুল, নানা রঙের পতুলিকা, ঘাসফুল, নয়নতারা, বিন্ডডিং হাট, রুয়েলিয়া, ম্যান্ডেলা, বেগম বাহার, হাজারি বেলি, করবী ও কলাবতী। গন্ধ না থাকলেও মুগ্ধতা ছড়ায়-কাঠ টগর, টগর, চীনা টগর, কুন্দসহ বিভিন্ন নাম জানা, না জানা বর্ষার শ্বেতবসনা।

বর্ষার সাদা ফুল দেখতে বর্ষার মধ্যেই বেরিয়ে পড়ি কিছু বাগান আর ছাদ-বাগানে। সাদা রঙের সুগন্ধ বিলানো ফুলগুলোর মধ্যে দেখা পাই বেলি, দোলনচাঁপা, কামিনী, সাদা কাঠগোলাপ, মালতী, সুগন্ধি বা অ্যারোমেটিক জুঁই, জুঁই বা যূথী, বকুল, গন্ধরাজ, শ্বেতচাঁপা, শ্বেতরঙ্গন, সুদর্শন বা স্পাইডার লিলি, রজনিগন্ধা ও মেহেদি ফুলের। গন্ধ না থাকলেও দেখা মেলে কাঠ টগর, টগর, চীনা টগর, শাপলা, কুন্দ, শ্বেতকাঞ্চন- এসব শুভ্র বসনাদের। তারার মতো মেলে থাকা পাঁচ পাপড়ির কাঠ টগর এ দেশে সাদা ফুল নামেও পরিচিত। বনে-জঙ্গলেও হয়।

ডালের আগায় কয়েকটা ফুল ফোটে থোকায় থোকায়, ফুল দেখতে চরকির মতো। চীনা টগর কাঠ টগরের জাতভাই হলেও এর পাতা ও ফুল আকারে অনেক ছোট। গাছ এত ঝোপালো হয় যে, ফুলগুলো ফুটলে মনে হয় সেসব ঝোপে যেন তারার মেলা বসেছে। টগর গাছ এ দুটোর চেয়ে একটু বড় হয়, ফুলও বড়, একাধিক সারি পাপড়ির ফুল। মালতী লতানো ফুল।

এগুলোও দেখতে তারার মতো। স্বর্ণচাঁপা আর শ্বেতচাঁপার পার্থক্য ফুলের রঙে- স্বর্ণচাঁপার রঙ হলদে, শ্বেতচাঁপা সাদা। সম্প্রতি এ দেশে আসা অ্যারোমেটিক বা ক্লিমেটিস জুঁই ফোটে প্রচুর, আর ঘ্রাণ ভেসে যায় অনেক দূর পর্যন্ত। দোলনচাঁপার ঘ্রাণও অনেক দূরে যায়। এ ফুলগাছ দেখতে অনেকটা আদা গাছের মতো।

কলাপাড়া সবুজবাগ এলাকার একাদ্বশ শ্রেনির ছাত্র আহসান হাবিব অনন্ত তার ঘরের পাশে কদম গাছটিতে ফুল ধরেছে। ওই শিক্ষার্থী জানান, এ ফুলটি আমার কাছে খুবই ভাল লাগে। বর্ষায় ফোটা ফুলগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কদম। আমরা যদি বাসা বাড়িতে এভাবে কদমসহ অনন্য ফুলের গাছ লাগায়ে তাহলে ফুলের সৌন্দর্য আরো বৃদ্ধি পাবে।

কলাপাড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো: আরাফাত হোসেন বলেন, বর্ষাকালে এ ফুলটি ফোটে। কদম ফুল সৌন্দর্য বন্ধন করে। এ ফুলটি সাদা ও হলুদ প্রকৃতি। কদম ফুলের পাতা কৃমি নাশক ঔষধ। এ বৃক্ষটি যেন হারিয়ে না যায়। আমরা সবাই সংরক্ষণ করি।