লালকুঠি : আবার বলবে তার গল্প

আনুষ্ঠানিকভাবে নর্থব্রুক হল নামে পরিচিত হলেও স্থানীয়ভাবে এই ভবনকে ডাকা হয় লালকুঠি নামে। যার লাল ইটের গাথুনির ভাজে ভাজে লুকিয়ে আছে শতবর্ষের গল্প।

রাজিয়া খাতুন

Location :

Dhaka City
লালকুঠি
লালকুঠি |নয়া দিগন্ত

পুরান ঢাকার সরু অলিগলি পেরিয়ে বুড়িগঙ্গার বাতাস গায়ে মেখে ওয়াইজঘাটের দিকে এগোলে একসময় চোখে পড়বে একটি পুরোনো লাল রঙের স্থাপনা। আনুষ্ঠানিকভাবে নর্থব্রুক হল নামে পরিচিত হলেও স্থানীয়ভাবে এই ভবনকে ডাকা হয় লালকুঠি নামে। যার লাল ইটের গাথুনির ভাজে ভাজে লুকিয়ে আছে শতবর্ষের গল্প। লালকুঠি একসময় ছিল শহরের সাংস্কৃতিক প্রাণকেন্দ্র। পরে অবহেলায় ঢাকা পড়ে যায় স্মৃতিস্তম্ভটির গৌরব। হারানো জৌলুস ফিরিয়ে আনতে চলছে সংস্কার কাজ। আগামী দুই মাসের মধ্যে স্থাপনাটি খুলে দেবে তার দ্বিতীয় জীবনের দরজা।

সরেজমিনে দেখা যায়, ভবনটিতে চলছে সংস্কার কাজ। নতুন রঙের প্রলেপে যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে দেড়শ’ বছরের পুরোনো লালকুঠির সৌন্দর্য। টাউন হল ও জনসন লাইব্রেরিতে ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে রঙের কাজ। ভবনের সামনে তৈরি করা হয়েছে মার্বেল পাথরের বৃহৎ ফোয়ারা। মূল কাঠামো, কাঠের দরজা-জানালা ও কারুকাজ পুনঃনির্মাণ করা হয়েছে আদি নকশা অনুসরণ করে।

Lalkuthi-02

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) সূত্রে জানা যায়, বিশ্বব্যাংকের ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্থায়নে লালকুঠি সংস্কার চলছে। এর তদারকি করছে ডিএসসিসি। প্রকল্পের কাজ ২০২৪ সালের জুলাই মাসে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও সংস্কার কাজ এখনো চলমান রয়েছে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা মোহাম্মদ শামসু বলেন, ২০২৩ সাল থেকে এখানে কাজ চলছে। আমরা আশা করছি আগামী দুই মাসের মধ্যে সংস্কারের কাজ শেষ হবে। এরপর লালকুঠি আবার খুলে দেওয়া হবে সাধারণ মানুষের জন্য।

Lalkuthi-03

লালকুঠির সংস্কারে স্থানীয়দের মধ্যেও নতুন করে আগ্রহ তৈরি করেছে। বাংলাবাজারের বাসিন্দা তরিকুল আলম বলেন, ছোটবেলায় ছুটির দিনে মা বাবার সাথে এখানে আসতাম। স্কুল কলেজে পড়াকালীন এই ভবনের সিঁড়িতে বসে বন্ধুবান্ধবের সাথে বসে কত আড্ডা দিয়েছি! এক সময় লালকুঠিতে সেমিনার, আলোচনা সভা ও কমিউনিটি গ্যাদারিং হতো।

ইতিহাসের সূচনা

১৮৭৪ সালে ভারতের গভর্নর জেনারেল জর্জ ব্যারিং নর্থব্রুকের ঢাকা সফরকে স্মরণীয় করে রাখতে স্থানীয় ধনাঢ্য ব্যক্তিরা উদ্যোগ নেন তাঁর নামে একটি টাউন হল নির্মাণের। ১৮৭৯ সালের শেষের দিকে নির্মাণ কাজ শেষ হয়। ১৮৮০ সালের ২৫ মে ঢাকার কমিশনার আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন এই ভবন। ভবনের লাল রঙ থেকেই পরবর্তীতে এর নাম হয় লালকুঠি।

Lalkuthi-04

প্রথম দিকে এখানে পদস্থ কর্মকর্তা ও অভিজাত সমাজের সভা, নাটক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। ১৮৮২ সালে এটি পাঠাগারে রূপান্তরিত হয় এবং যুক্ত করা হয় জনসন হল নামে একটি ক্লাবঘর। কয়েক বছরের মধ্যেই এর বইয়ের সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। ১৮৮৭ সালে বিলেত থেকে বই আনার ঘটনাও রয়েছে এর ইতিহাসে।

রবীন্দ্রনাথের সংবর্ধনা থেকে নাট্যচর্চার স্বর্ণযুগ

১৯২৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি এখানে ঢাকা পৌরসভা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নাগরিক সংবর্ধনা দেয়। ষাটের দশকে লালকুঠি হয়ে ওঠে নাট্যচর্চার কেন্দ্রস্থল। প্রবীর মিত্র, আতিকুর রহমান খানসহ বহু শিল্পী এখানে নাটক মঞ্চস্থ করেছেন। সে সময় প্রতি সপ্তাহেই নাটক হতো। আর মহড়ায়ও থাকত দর্শকের ভিড়। নারীদের অংশগ্রহণও লক্ষ্যণীয় ছিল। আজকের বেইলি রোডের মতো লালকুঠি ছিলো তখনকার ঢাকার বিনোদন ও সংস্কৃতি চর্চার প্রাণকেন্দ্র।

অবক্ষয়ের পথে

পাকিস্তান আমল থেকেই লালকুঠির অবনতি শুরু হয়। কর্তৃপক্ষের অবহেলায় পাঠাগার ও ভবন হারাতে থাকে তার ঐতিহ্য। মুক্তিযুদ্ধের সময় অধিকাংশ বই নষ্ট হয়ে যায়। স্বাধীনতার পরও তেমন সংস্কার হয়নি। এখানে ফরাশগঞ্জ স্পোর্টিং ক্লাব, কমিশনারের কার্যালয় ও কমিউনিটি সেন্টার থাকলেও মূল ভবন অযত্নে জীর্ণ হয়ে পড়েছিলো। ২০১৬ সাল থেকে এটি আর মিলনায়তন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিল না। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন বর্তমানে ভবনটির পুনঃসংস্কার ও সংরক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

Lalkuthi-05

স্থাপত্য বিশেষজ্ঞ তৈমুর ইসলাম বলেন, লালকুঠি মোগল ও ব্রিটিশ স্থাপত্যশৈলীর এক বিরল নিদর্শন। এই জায়গাটি সংস্কার করে যদি সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত রাখা যায়, তবে পুরান ঢাকার সংস্কৃতিকেন্দ্র হিসেবে এটি পুনরুজ্জীবিত হতে পারে।

লালকুঠি তার পুরোনো গৌরব ফিরে পেতে যাচ্ছে। বুড়িগঙ্গার তীরে দাঁড়িয়ে থাকা এই লাল রঙের ভবন একদিন আবার বলবে শহরের সংস্কৃতি আর ইতিহাসের গল্প। সেই দিন আর দূরে নেই।