মো: মিজানুর রহমান, বোরহানউদ্দিন (ভোলা)
দক্ষিণাঞ্চলের দ্বীপজেলা ভোলা বরাবরই খাঁটি ও প্রাকৃতিক খাদ্যপণ্যের জন্য প্রসিদ্ধ। সেই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় এবার দেশের খাদ্য সংস্কৃতিতে যুক্ত হলো একটি নতুন স্বীকৃতিপ্রাপ্ত নাম- ‘মহিষের দুধের টক দই’, যা সম্প্রতি পেয়েছে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতি। এই স্বীকৃতি শুধু এর গুণগত মানের প্রমাণ নয়, বরং এটি একটি সম্পূর্ণ অঞ্চলের সাংস্কৃতিক পরিচয় ও সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
বোরহানউদ্দিন পশু হাসপাতালের ডা: নাজনীন জানান, মহিষের দই পুষ্টিগুণে ভরপুর। এটি হজমে সহায়ক, হৃদ্রোগ প্রতিরোধে কার্যকর এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ভূমিকা রাখে। এতে রয়েছে ভিটামিন, প্রোটিন এবং ক্যালসিয়াম। প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া সমৃদ্ধ এই দই হজম স্বাস্থ্যের জন্য বিশেষভাবে উপকারী।
ভোলার চরাঞ্চলে বেড়ে ওঠা দেশি মহিষের খাঁটি দুধ দিয়ে তৈরি এই দই সম্পূর্ণ প্রাকৃতিকভাবে, কোনো কৃত্রিম উপাদান বা প্রিজারভেটিভ ছাড়াই প্রস্তুত করা হয়। দুধ সংগ্রহের পর এটি বিশেষভাবে ফার্মেন্ট করে মাটির পাত্রে রাখা হয়, যাতে স্বাভাবিকভাবেই তৈরি হয় ল্যাকটিক অ্যাসিড- যা দইয়ের স্বাদ ও পুষ্টিগুণ বৃদ্ধি করে।
স্থানীয় খামারি বাবুল ঘোষ জানান, পাতার চর, বান্দরইয়া চর, চর শ্রীনাথসহ বিভিন্ন চরে প্রায় ২০০০ মহিষ রয়েছে। তিনি ও তার দলের ২০ জন সদস্য আট ভাগে এই মহিষ পালন করে থাকেন। প্রতিদিন প্রায় ৪০ মন দুধ সংগ্রহ করা হয়, যা বোরহানউদ্দিন, লালমোহনসহ বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ হয়। এখানকার দই প্রস্তুত প্রক্রিয়াও একটি পারিবারিক ঐতিহ্য হিসেবে বিবেচিত।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মহিষের দুধে সাধারণ গরুর দুধের তুলনায় বেশি চর্বি ও প্রোটিন থাকে, ফলে এই দই হয় ঘন, মসৃণ ও অধিক পুষ্টিকর। এখন এটি কেবল গ্রামের খাবার নয়, বরং শহরের মানুষও এটি গ্রহণ করছে ডেজার্ট হিসেবে বা গুড়, চিনি, চিড়া-ভাতের সাথে। অনেকেই এটিকে রান্নায় ব্যবহার করছেন বিরিয়ানি, খিচুড়ি, সালাদ কিংবা বোরহারি তৈরি হয়।
মহিষের দুধের টক দই এখন কেবল একটি খাদ্যপণ্য নয়, বরং হয়ে উঠেছে একটি গ্রামীণ ব্র্যান্ড। এটি একদিকে শহরবাসীকে দিচ্ছে পুষ্টিকর ও নিরাপদ খাবার, অন্যদিকে চরাঞ্চলের দুধ সংগ্রাহক ও ছোট কৃষকদের জন্য তৈরি করছে আয় ও বাজার সংযোগের নতুন সুযোগ। এতে করে জোরদার হচ্ছে দেশের গ্রামীণ অর্থনীতি।
ঢাকায় এই দইয়ের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এখন অনলাইন প্রতিষ্ঠান (সেইফ বাজার) এটি শহরবাসীর দোরগোড়ায় পৌঁছে দিচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির ফাউন্ডার ও সিইও মো: মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘ভোলার ঐতিহ্যবাহী এই দই এখন অনেক জায়গায় পাওয়া যায় না। তাই নিরাপদ, হালাল ও মানসম্পন্ন দই পৌঁছে দিতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
এক সময় গ্রামের হাটে-বাজারে সীমাবদ্ধ থাকা এই টক দই এখন রাজধানীর ডাইনিং টেবিলে জায়গা করে নিচ্ছে। এটি শুধু দই নয় একটি অঞ্চলের জীবনধারা, সংস্কৃতি ও সম্ভাবনার ঘন স্বাদ।