১৩তম মৃত্যুবার্ষিকী

অনুভবে ও কৈশোরে আমার হুমায়ূন

মিজান ফারাবী
হুমায়ূন আহমেদ
হুমায়ূন আহমেদ |ইন্টারনেট

দিন তারিখ মনে নেই, সম্ভবত দুই হাজার আট সাল। গল্পটা বলি। একাডেমিক বইয়ের বাইরে সবেমাত্র দুয়েকটা বই পড়া শুরু করেছি তখন। আলাদা একটা ভালোলাগা কাজ করতো। ওই সময়ে হুমায়ূনের লেখা পড়েছিলাম পত্রিকায়, সাময়িকীতে। তারও অনেক পরে গল্পের বই পড়লাম।

Ochinpur-humayun

বিকেলে খেলার রুটিন থাকলেও মাঝে মধ্যে টুকটাক বইয়ে চোখ রাখতাম। ক্লাসের বইয়ের চেয়ে বড় ভাইয়ের সংগ্রহে থাকা নানান বই, পত্রিকা, কিশোর ম্যাগাজিন নিয়ে চলে যেতাম, কখনো ঘরে আবার কখনো বিকেলে কোনো গাছ তলায় পাটি বিছিয়ে বসতাম। এভাবেই শুরু হলো আমার কৈশোরে হুমায়ূনের সাথে পরিচয়।

গ্রামের বাজারে পুরনো যে কয়টা বইয়ের দোকান আছে তার একটা ভৌমিক লাইব্রেরি। বইটই কেনার জন্য আব্বার সাথেই প্রায় যেতাম। সেই সুবাদে পরিচয়। একবার একাডেমিক বই কিনতে গিয়ে অনেকটা উপরের তাকে চোখে পড়লো ‘অচিনপুর’ নামের একটা বই। পাশে হুমায়ূন লেখা। হুমায়ূনের লেখার সাথে তখন অল্প বিস্তর পরিচয়। বইয়ের পর বই লিখে যখন হুমায়ূন ইতিহাস হচ্ছেন তখন আমি কৈশরে।

গ্রামে তেমন একটা বেচা-বিক্রি হয় না বলে ধুলোবালি পড়ে আছে। নামিয়ে দিতেও যেন অলসতা। দাদা, আমাকে জিজ্ঞেস করলো তুই নিবি? নিবো, দেন। অচিনপুর নামটা ভালো লাগলো। অনেকটা টেনে ধরলো যেন বলছে আমারে নিয়ে যা। বইটা নিয়ে বাড়িতে যাবার অপেক্ষা, বিকেলেই পড়বো।

নুহাশ পল্লীতে বৃষ্টি বিলাস

হুমায়ূনের অন্য অনেক বইয়ের তুলনায় এটা ছোট বই। পড়তেই শেষ হয়ে যাবে। অল্প পড়ে আবার রেখে দেই। শেষ না করে রাতে বালিশের পাশে রাখলাম। পাশে অচিনপুর নিয়ে ঘুমালাম। একবার সুন্দরপুর নামে একটা নাটক দেখছিলাম টেলিভিশনে। ওই দৃশ্যটা বারবার সামনে আসতে লাগল। ভাবছিলাম অচিনপুরও কী এরকম সুন্দর একটা গ্রাম! কখন সকাল হবে, অপেক্ষায়। এর মধ্যে কৌতূহলে বালিশের পাশে হাত দিয়ে কয়েকবার দেখলাম বইটা আছে কি-না। আনন্দে আমার ঘুম হচ্ছে না। পর দিন ছিল শুক্রবার। বইটার সাথেই আমার দিন কাটল।

আমরা থাকি অচিনপুরে যার সবটা আমাদের চেনা হয় না। এই না চেনার জগতে থাকার সময় ফুরিয়ে এলেও আবারো পাড়ি জমাই আরেকটা অচিনপুরে। হুমায়ূনের গ্রাম নিয়ে অনেক গল্প পাবেন। আছে কিছুটা ছোট মলাটের উপন্যাসও। অচিনপুরটাও অনেকটা এরকম। এটা হুমায়ূনের প্রথম দিকের লেখা তৃতীয় গল্পের বই।

লেখায় অল্প কথায় অনেক কিছু হাজির করে পাঠকের মনে। এটাও সেই রকমের। হুমায়ূনের নিজস্ব লেখার যে ছাপ তা এখানে পাঠক ধরতে পারবেন। একটা গ্রামের পরিবার বা গ্রামবাংলার চিত্র রূপায়নে চেনা হুমায়ূন পা বাড়ালেন গল্পে, অচিনপুরে। তো, কৈশরে যে পড়লাম এর কিছুই মনে নেই। এটা পরের বারের স্মৃতি বললাম।

নুহাশ পল্লীর নয়ানাভিরাম দৃশ্য

সেই প্রথম সংগ্রহের বইটাও আমার কাছে নেই, কেউ নিয়ে গেছে অথবা ঘর মেরামতের পর আর খুঁজে পাইনি। স্মৃতির বইটা না পাওয়া বেদনার। অনেক বছর পরে চট্টগ্রামের নিউমার্কেটের বইঘর থেকে বইটা আবার কিনেছিলাম। হুমায়ূনের যে বইগুলো কয়েকবার পড়া হয়েছে এটা তার একটা।

বৃষ্টি, বসন্ত ও জোছনা লেখকের ভীষণ রকমের ভালো লাগতো। এটা তার বহু লেখায়, আবেগ ও ভাবে প্রকাশ পেয়েছে। তার একটা গানেও একথা বলেছেন এমন- ও কারিগর, দয়ার সাগর, ওগো দয়াময়, চান্নি পসর রাইতে যেন আমার মরণ হয়।

তার লেখা বৃষ্টি বিলাস, বাদশাহ নামদার, নীলাবতী, অপেক্ষা, বসন্ত বিলাপ, নির্বাসন, ফাউন্টেনপেন, দেয়াল, জোছনা ও জননীর গল্প ও ভ্রমণ গল্পে এমন অনেক ছাপ রেখে গেছে। শুরুর দিকের অন্য আরো স্মৃতি আছে। হুমায়ূন নিয়ে বলতে গেলে অচিনপুর পড়াটা আমার একাডেমিক বইয়ের বাইরে প্রথম স্মৃতি। সুযোগ পেলে আবার পড়বো— হারাবো হুমায়ূনের অচিনপুরে।

মৃত্যুবাষিকীতে লেখকের কবরের পাশে

আজ ১৯ জুলাই হুমায়ুন আহমেদের ১৩তম মৃত্যুবার্ষিকী। এমন বর্ষা বাদলের দিনেই বিদায় নিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের বরেণ্য এই কথাসাহিত্যিক। শ্রাবণের এই ঘোর লাঘা দিনে মনে পড়ে তোমায়- প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ। গাজীপুরে স্বপ্নের বাগানবাড়ি চিরসবুজের নুহাশ পল্লীতে তাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়।