দূর থেকে দেখলে মনে হবে সবুজে ঢাকা এক নির্জন মাঠ বা ঘাসে ঢাকা টিলা। কিন্তু তার ভিতরে লুকিয়ে আছে এমন এক স্থাপনা যা প্রথম দর্শনে চোখেই পড়ে না। কারণ সেটি যেন মাটির সঙ্গে মিশে আছে প্রকৃতির অংশ হয়ে।
এই অদ্ভুত অথচ মনোমুগ্ধকর স্থাপনার নাম ফ্রেন্ডশিপ সেন্টার। গাইবান্ধা শহর থেকে প্রায় চার কিলোমিটার পূর্বে ফুলছড়ি উপজেলার মদনেরপাড়া গ্রামে সেন্টারটি অবস্থিত। এই সেন্টারটি দুর্গম চরাঞ্চলের মানুষদের প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য ২০১২ সাল থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
স্থপতি
ফ্রেন্ডশিপ সেন্টার শুধু একটি প্রশিক্ষণ ভবন নয়। এটি একটি দর্শন। যেখানে স্থাপত্য, প্রকৃতি ও মানবসেবার ভাবনা একাকার হয়ে গেছে। প্রায় ৩২ হাজার বর্গফুট জায়গাজুড়ে নির্মিত এই ভবনটি ডিজাইন করেছেন খ্যাতনামা স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরী ও তার প্রতিষ্ঠান আরবানা (Urbana)।

স্থপতির ভাষায়, “এটি এমন এক স্থাপনা যা প্রকৃতির সঙ্গে প্রতিযোগিতা নয় বরং সহাবস্থানে বিশ্বাস করে।” ভবনের প্রতিটি ইট, প্রতিটি খোলা উঠান সেই চিন্তার প্রতিফলন। প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার মহাস্থানগড়ের স্থাপত্যরীতি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এখানে তৈরি হয়েছে একের পর এক উঠান, করিডর ও খোলা আলো-বাতাসের পথ।
২০১২ সালের ১৮ নভেম্বর ফ্রেন্ডশিপ সেন্টারটি উদ্বোধন করা হয়। এটি নির্মাণে ব্যয় হয় প্রায় আট কোটি টাকা।
মালিকানা
ফ্রেন্ডশিপ সেন্টার মূলত ‘ফ্রেন্ডশিপ’ নামক অর্গানাইজেশন (সংস্থা) কর্তৃক পরিচালিত হয়। ফ্রেন্ডশিপ শুধু কাজ করে ডেভেলভমেন্ট সেক্টর নিয়ে। ফ্রেন্ডশিপ একটি ননপ্রফিটএবল অর্গানাইজেশন (অলাভজনক সংস্থা)।
ফ্রেন্ডশিপ নামের এই বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাটি বহু বছর ধরে দেশের উত্তরাঞ্চলের চর ও বন্যাপ্রবণ এলাকায় স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও জীবিকা উন্নয়ন নিয়ে কাজ করছে। একইসাথে গাইবান্ধার এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি মূলত ফ্রেন্ডশিপের মাঠপর্যায়ের কর্মী ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য একটি শিক্ষা ও সক্ষমতা উন্নয়ন কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে।

নির্মাণসামগ্রী
ফ্রেন্ডশিপ সেন্টারটি নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে স্থানীয় লাল ইট, পাথর, বালি, কংক্রিট ও সীমিত পরিমাণে কাঠ। পর্যাপ্ত আলো ও বাতাস প্রবেশের জন্য রাখা হয়েছে প্রাকৃতিক স্কাইলাইট ও খোলা ছিদ্র। আর ছাদে লাগানো ঘাস গরমে শীতলতা ও পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রাখে।
স্থাপনা কাঠামো ও সুযোগ-সুবিধা
ফ্রেন্ডশিপ সেন্টারের দুটি প্রধান ব্লক আছে। একটি ব্লকে রয়েছে শ্রেণিকক্ষ, লাইব্রেরি, অফিস, প্রার্থনাকক্ষ ও বিশ্রাম কক্ষ। অন্য ব্লকে আছে আবাসিক ঘর, খাবার ঘর ও অতিথিশালা।
সেন্টারটিতে ফ্যাসিলিটি বা সুযোগ-সুবিধা হিসেবে আছে দুটি বিশাল আকৃতির সেমিনার রুম বা ওয়ার্কশপ রুম। যেখানে প্রায় ২০০ জন প্রশিক্ষণার্থী একসঙ্গে প্রশিক্ষণ নিতে পারেন। থাকার জন্য ৪৮ জনের থাকার সুব্যবস্থা আছে।

এখানে খাবারের ডাইনিং আছে যেখানে ৭০ জন বসে একসাথে খেতে পারে। পুরুষ ও মহিলাদের জন্য আলাদা থাকার ব্যবস্থা করা আছে।
যেসব গেস্ট বা অতিথি দেশের বাইরে থেকে আসে তাদের জন্য থাকার আলাদা ব্যবস্থা আছে। এছাড়া স্টাফদের থাকার জন্যও আলাদা ব্যবস্থা করা আছে।
এখানে কম্পিউটার বেইজড লাইব্রেরি আছে, অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ (প্রসাশনিক) রুম আছে, নামাজের জায়গা আছে। ট্রেনিং সেশনের গ্রুপ ওয়ার্ক, গ্রুপ ডিসকাশন করা জন্য দুইটা প্যাভিলিয়ন আছে। ট্রেইনি (প্রশিক্ষক) বা ট্রেইনারদের (প্রশিক্ষণার্থী) বাচ্চা বা গাইড থাকলে তারা যেন বিনোদনের জন্য ছোট্ট একটি ইনডোর গেইমের ব্যবস্থা আছে।
স্থাপত্য জগতের স্বীকৃতি
২০১৬ সালে ফ্রেন্ডশিপ সেন্টার বিশ্বের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ স্থাপত্য সম্মান “আগা খান অ্যাওয়ার্ড ফর আর্কিটেকচার” অর্জন করে। যেখানে ৬৯টি দেশের একশত ৮৪টি স্থাপনার মধ্যে ফ্রেন্ডশিপ সেন্টার যৌথভাবে এই অ্যাওয়ার্ড অর্জন করে। জুরি বোর্ডের ভাষায়, “এটি এমন এক স্থাপনা, যা স্থানীয় জলবায়ু, প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণতা ও সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আধুনিক চিন্তার রূপ দিয়েছে।”

এর আগে ২০১২ সালে এটি লন্ডনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আর্কিটেক্ট রিভিউ AR+D (এআর প্লাস ডি) Architecture Award পেয়েছিল। আন্তর্জাতিক স্থাপত্য সাময়িকী Metalocus, World-Architects ও AKDN–এর প্রশংসাপত্রে বলা হয়, “ফ্রেন্ডশিপ সেন্টার এমন এক নকশা যা প্রমাণ করে দারিদ্র্য ও প্রান্তিকতাও হতে পারে নান্দনিকতা ও ন্যায়ভিত্তিক স্থাপত্যচিন্তার উৎস।”
পরিবেশবান্ধব নকশা
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে বন্যা ও তাপপ্রবাহ—দুটিই সাধারণ ঘটনা। এই প্রেক্ষাপটে ভবনটির মাটির সমতল নকশা শুধু নান্দনিক নয়, টেকসই ও পরিবেশবান্ধবও বটে।
বাতাস চলাচলের জন্য রাখা হয়েছে প্যাভিলিয়ন শৈলীর করিডর। আর প্রাকৃতিক আলো পাওয়ার জন্য রয়েছে স্কাইলাইট ও খোলা ছাদ। ফলে দিনের বেলায় বৈদ্যুতিক আলোর প্রয়োজন হয় না বললেই চলে।
বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের জন্য তৈরি করা হয়েছে আধুনিক ড্রেনেজ ব্যবস্থা। বৃষ্টি পানি নিয়ন্ত্রণে ভিতরে চারটি ওয়াটার বডি (ছোট পুকুর) আছে। বডিগুলো প্রত্যেকটি একে অপরের সাথে পাইপের মাধ্যমে সংযুক্ত করা আছে। ওয়াটার বডিগুলোতে পানির লেভেল ক্রস করলেই পানিগুলো বাইফোর্সিং সাবমারসিবল পাম্পের মাধ্যমে বাইরের পুকুরে চলে যায়।

ফ্রেন্ডশিপকে সহায়তাকারী দেশ
ফ্রেন্ডশিপ সেন্টারকে সহযোগিতা করে থাকে অর্থাৎ ফ্রেন্ডশিপকে বিভিন্ন প্রোগ্রামের মাধ্যমে ডোনেট করে থাকে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা। ইউরোপিয়ান বেশকিছু দেশ যেমন লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, বেলজিয়াম ফ্রেন্ডশিপকে সহযোগিতা করে থাকে।
ফ্রেন্ডশিপের কার্যক্রম
ফ্রেন্ডশিপ চরাঞ্চলে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে। গাইবান্ধায় ফ্রেন্ডশিপ পরিচালিত ১৫টি প্রাইমারি স্কুল, ৫টি হাইস্কুল এবং ৮৭টি এডাল্ট এডুকেশন সেন্টার আছে। এখানকার টিচাররা এসএসসি পাশ বা এইচএসসি পাশ। তাদেরকে প্রত্যেক মাসে তিনদিন, পাঁচদিন বা সাতদিন ফ্রেন্ডশিপ সেন্টারে রেখে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
এছাড়া ফ্রেন্ডশিপ সেন্টার যেসব প্রশিক্ষণ দেয়-
১. গ্রামীণ স্বাস্থ্য সচেতনতা প্রশিক্ষণ। ফ্রেন্ডশিপ কমিউনিটি মেডিক্ (এফসিএম)-এ যারা স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করে তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।

২. প্যারালিগাল বা আইনি সহায়তা প্রদানকারীদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
৩. উইভিং বা তাঁত বুনন প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয় এবং
৪. সোলার টেকনিসিয়ানদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
স্থানীয়দের মতামত
মদনেরপাড়া গ্রামের স্থানীয়রা বলছেন, ফ্রেন্ডশিপ সেন্টারে চরাঞ্চলের শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে সব বয়সের নারী-পুরুষদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। তারা প্রতিমাসে তিন থেকে সাতদিন এখানে থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এতে চরাঞ্চলের অসহায় মানুষগুলো নানাভাবে উপকৃত হচ্ছে।
আবার প্রতিদিন দেশ ও দেশের বাইরে থেকে দর্শনার্থীরা ফ্রেন্ডশিপ সেন্টারটি পরিদর্শনে আসছে। এতে গ্রাম এবং দেশের নাম উজ্জ্বল হচ্ছে। এটি একইসাথে আনন্দের এবং গর্বের বিষয়।
তবে ফ্রেন্ডশিপ স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য কোনো কার্যক্রম পরিচালনা করেনি। এতে চরাঞ্চলের মানুষরা উপকৃত হলেও স্থানীয়রা তা থেকে বঞ্চিত। এছাড়া স্থানীয়দের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও হয়নি।

স্থানীয় বাসিন্দা শান্তনা খাতুন (সহকারি শিক্ষক, প্রাথমিক বিদ্যালয়) বলেন, ফ্রেন্ডশিপ সেন্টার প্রতিষ্ঠার পর আমাদের গ্রামের পরিচিতি অনেক বেড়েছে। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও সচেতনতামূলক কার্যক্রমে চরাঞ্চলের মানুষ উপকৃত হচ্ছে। তবে স্থানীয় বেকারদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি খুব একটা ভূমিকা রাখছে না। অধিকাংশ পদেই বাইরের লোক নিয়োগ পেয়েছেন।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাগর মিয়া বলেন, ফ্রেন্ডশিপ সেন্টারের মতো একটি আন্তর্জাতিক মানের স্থাপনা আমাদের গ্রামে হওয়ায় আমরা গর্বিত। এটি দেশের স্থাপত্যকলার এক অসাধারণ নিদর্শন। তবে, স্থানীয় হিসেবে আমাদের প্রত্যাশা ছিল যে এই প্রতিষ্ঠান গ্রামের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে আরও বেশি ভূমিকা রাখবে। চরাঞ্চলের মানুষের জন্য যেমন কার্যক্রম আছে, তেমনি মদনেরপাড়া গ্রামের স্থানীয়দের জন্যও সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ নেওয়া উচিত। কর্মসংস্থানের পাশাপাশি স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরার সুযোগও সৃষ্টি করা যেতে পারে।
ফ্রেন্ডশিপ সেন্টারের সিনিয়র ম্যানেজার লোকমান হোসেন বলেন, ফ্রেন্ডশিপ সেন্টার গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার মদনেরপাড়ায় ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি অনন্য স্থাপত্য। এটি মহাস্থানগড়ের আদলে মাটির নিচে নির্মিত একটি ইকো-ফ্রেন্ডলি কাঠামো। যা ২০১৬ সালে আগা খান অ্যাওয়ার্ড অর্জন করে। সেন্টারটি মূলত ফ্রেন্ডশিপের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অন্যান্য উন্নয়নমূলক প্রকল্পের স্টাফ এবং সুবিধাভোগীদের জন্য নিড-বেইজড ট্রেনিং ও ক্যাপাসিটি বিল্ডআপের কাজে ব্যবহৃত হয়। স্থাপনাটির নান্দনিকতা গ্রামের সৌন্দর্য রক্ষা করে এবং এটি স্থানীয় অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
যেভাবে যাবেন
গাইবান্ধা বাস টার্মিনাল বা রেলওয়ে স্টেশন থেকে ব্যাটারিচালিত অটো রিকশায় জনপ্রতি ২০-৩০ টাকায় সরাসরি ফ্রেন্ডশিপ সেন্টারে যাওয়া যায়।
ফ্রেন্ডশিপে সেন্টারে প্রবেশে কোনো ফি নেয়া হয় না। তবে এটি একটি ট্রেনিং সেন্টার হওয়ায় এখানে সাধারণের প্রবেশ সংরক্ষিত। তবে বিশেষ অনুমতি সাপেক্ষে এখানে প্রবেশ করা যায়।
লেখক: নয়া দিগন্তের ইন্টার্ন শিক্ষার্থী।



