জীবনের গল্প অনেক সময় কল্পনাকেও হার মানায়। নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে মানুষকে। স্বামী, সন্তান নিয়ে সুখের সংসার করার স্বপ্ন দেখেন নারীরা। তবে সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেয় না কখনো কখনো। স্থির হয় না সবার জীবনে। বাস্তবতার সামনে সব অনুভূতি মলিন হয়ে যায়।
এমনই কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি ঠাকুরগাঁওয়ের জান্নাত বেগম। অবুঝ চার শিশুকে খাঁচায় বন্দি করে ঘুরছেন পথে পথে, মানুষের দ্বারে। সন্তানদের মুখে একটু খাবার তুলে দিতে হাত পাতছেন মানুষের কাছে। স্বামী থেকেও যেন কেউ নেই তার। সব প্রতিকূলতা ভেঙে সন্তানদের নিয়ে বেঁচে থাকার লড়াই করে যাচ্ছেন জান্নাত।
ঠাকুরগাঁও পরিষদপাড়া কিংবা কাঁচাবাজার আড়ত এলাকায় গেলে দেখা মিলবে লোহা দিয়ে বানানো খাঁচায় চাকা লাগিয়ে তৈরি করেছেন ঠেলা গাড়ি। সেই গাড়িতে ১৩ মাস বয়সী তিন শিশুকে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন জান্নাত বেগম। খাঁচার পাশে তার সাথেই হাঁটছে সাড়ে তিন বছর বয়সী আরো এক সন্তান। ক্লান্ত হয়ে গেলে তাকেও খাঁচায় তুলে দিচ্ছেন। এভাবেই দিনাতিপাত করছেন জান্নাত বেগম।
জানা গেছে, ১৩ মাস বয়সী তিন জমজ শিশু আব্দুল্লাহ, আমেনা ও আয়শা। সেই সাথে সাড়ে তিন বছর বয়সী মরিয়মসহ চার শিশু সন্তানের জননী জান্নাত বেগম। বছর পাঁচেক আগে ঢাকায় সম্পর্ক গড়ে বিয়ে হয় ঠাকুরগাঁওয়ের হাবিলের সাথে। বিয়ের পর হাবিলের সাথে ঠাকুরগাঁও চলে আসেন ময়মনসিংহের মেয়ে জান্নাত। দেড় বছর পর তাদের ঘর আলো করে আসে এক কন্যা সন্তান।
এর প্রায় দু’বছর পরে একই সাথে জান্নাত জন্ম দেয় তিন জমজ সন্তান। তার মধ্যে দু’কন্যা ও এক ছেলে। সন্তান হওয়ার কিছু দিন পরেই জান্নাতকে ছেড়ে চলে যায় তার স্বামী হাবিল। এর পর থেকেই চার শিশু সন্তানকে নিয়ে বিপাকে পড়েন অসহায় মা। অল্প বয়সী চার শিশুকে রেখে কোথাও কাজ করে উপার্জনের উপায় পাচ্ছিলেন না তিনি। তবে যেভাবেই হোক সন্তানদের ক্ষুধা নিবারণ করতে এক অভিনব উপায় খুঁজে বের করেন মা জান্নাত।
সাত হাজার টাকা খরচ করে কামারের দোকানে চাকা লাগানো একটি লোহার খাঁচা তৈরি করান। সেই খাঁচার ভেতরে ১৩ মাসের তিন শিশুকে এবং সাড়ে তিন বছরে আরেক শিশুকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন সাহায্যের আশায়। বিভিন্ন সময় অনেকেই তার সন্তানদের কিনে নিতে লাখ লাখ টাকার প্রস্তাব দিয়েছে। মাতৃত্বের পরম মায়ার কাছে হার মেনেছে টাকা। সন্তানদের কষ্ট করে আগলে রেখেছেন তিনি।
জান্নাত বেগম বলেন, আমি সাহায্য তুলে দিনযাপন করছি। যা আমার জন্যে অবশ্যই লজ্জার। তবে এছাড়া আমার কোনো উপায় নেই। বিভিন্ন সময় বাসাবাড়িতে কাজের প্রস্তাব পেয়েছি, কিন্তু ছোট চার শিশু বাচ্চাদের কার কাছে রেখে কাজে যাব? তাই আমার পক্ষে কোথাও কাজ করার সুযোগ হয়ে ওঠেনি।
তিনি বলেন, উপায় না পেয়ে সাত হাজার টাকা খরচ করে এই চাকাসহ খাঁচার গাড়িটি বানিয়েছি। সন্তানদের এই খাঁচায় করে নিয়েই এখন আমি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে সাহায্য তুলি। তবে এভাবে ঘুরে খুব বেশি পরিমাণে অর্থ উপার্জন করতে পারি না। তাই আমার সন্তানদের যথাযোগ্য পুষ্টিকর খাবার কখনো দিতে পারি না। ওরা তো দুধের বাচ্চা, বুকের দুধ পায় না। কৌটার দুধও কিনে খাওয়াতে পারি না। অনেক সময় তারা পেট ভরে খাবার না পেয়ে খুব কান্নাকাটি করে।
জান্নাতের প্রতিবেশীরা প্রায়শই তার এই কষ্টের জীবন দেখে আফসোস করে। অনেক সময় তারা জান্নাতের সন্তানদের ক্ষুধার জ্বালায় কান্নাকাটি করতেও দেখে। ওই সময় প্রতিবেশীরা সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন।
প্রতিবেশীরা জানায়, যেকোনো নারীর পক্ষে এত ছোট ছোট চারটি বাচ্চা লালনপালন করা বেশ কষ্টকর। কিন্তু সেখানে এই নারী বাচ্চাদের লালন-পালনের পাশাপাশি উপার্জনের দায়িত্ব নিতে হচ্ছে। এই নারীকে দেখলেই বোঝা যায় একটা মানুষ কতটা অসহায় হতে পারে। অনেক সময় তার বাচ্চাদের কান্নার শব্দ শুনলে খুবই খারাপ লাগে। পেট ভরে খাবারও পায় না তারা। প্রতিবেশীরা সামান্য সহযোগিতার চেষ্টা করলেও তা যথেষ্ট নয়। বিত্তশালীরা কত কত জায়গায় সাহায্য সহযোগিতা করে থাকে। কিন্তু এই নারীকে কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি।