ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান ষাট গম্বুজ মসজিদ

মসজিদের গায়ে কোনো শিলালিপি না থাকায় এটি কে নির্মাণ করেছিলেন বা কোন সময়ে নির্মাণ করা হয়েছিল সে সম্পর্কে লিখিত কোনো প্রমাণ নেই। তবে স্থাপত্যশৈলী দেখলে বুঝা যায় এটি সুন্দরবন অঞ্চলের গভর্নর খান জাহান আলী নির্মাণ করেছিলেন।

ছামিয়া আক্তার

সুলতানি আমলে নির্মিত যে কয়টি স্থাপনা এখনো পর্যন্ত দৃশ্যমান ষাট গম্বুজ মসজিদ এদের মধ্যে একটি। স্থাপনাটির নির্মাণশৈলী আর কারুকার্য দর্শণার্থীদের নজর কাড়ে। ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলোর মধ্যে বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদ একটি। প্রতিদিন দেশ-বিদেশ থেকে হাজারো মানুষ মসজিদটি দেখতে আসেন।

মসজিদের গায়ে কোনো শিলালিপি না থাকায় এটি কে নির্মাণ করেছিলেন বা কোন সময়ে নির্মাণ করা হয়েছিল সে সম্পর্কে লিখিত কোনো প্রমাণ নেই। তবে স্থাপত্যশৈলী দেখলে বুঝা যায় এটি সুন্দরবন অঞ্চলের গভর্নর খান জাহান আলী নির্মাণ করেছিলেন।

Shat Gambuj Mosque-02

ভিতরে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে জাদুঘর। সেখানে রয়েছে পেয়েছে সুলতানি আমলে ব্যবহৃত বিভিন্ন তৈজসপত্র, মুদ্রা ও লিপিবদ্ধ ইতিহাস। তাছাড়া জাদুঘরের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হলো ঐতিহাসিক কুমিরের মমি।

মসজিদটির পূর্ব পাশের দেয়ালে ১১টি বিরাট আকারের খিলানযুক্ত দরজা রয়েছে। মাঝের প্রধান দরজাটি অন্যগুলোর চেয়ে বড়। উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে আছে ৭টি করে দরজা। মসজিদের চার কোণে চারটি মিনার রয়েছে যেগুলোর উচ্চতা, ছাদের কার্নিশের চেয়ে বেশি। সামনের দুটি মিনারে প্যাঁচানো সিঁড়ি আছে এবং এখান থেকে একসময় আজান দেবার ব্যবস্থা ছিলো।

মসজিদটির নাম ষাট গম্বুজ মসজিদ হলেও এখানে কিন্তু গম্বুজ ৬০টি নয়,বরং এর গম্বুজ সংখ্যা ৮১টি। এই ৬০টি পিলার ও চারপাশের দেয়ালের ওপর তৈরি করা হয়েছে গম্বুজ। উত্তর থেকে দক্ষিণে ছয় সারিতে গম্বুজগুলো অবস্থিত এবং প্রত্যেক সারিতে ১০টি করে পিলার আছে। প্রতিটি পিলারই পাথর কেটে বানানো হয়েছে, কিন্তু পাঁচটি স্তম্ভ বাইরে থেকে ইট দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। ৭৭টি গম্বুজের মধ্যে ৭০ টির উপরিভাগ গোলাকার এবং পূর্ব দেয়ালের মাঝের দরজা ও পশ্চিম দেয়ালের মাঝের মিহরাবের মধ্যবর্তী সারিতে যে সাতটি গম্বুজ সেগুলো দেখতে অনেকটা চতুর্ভূজ আকৃতির।

Shat Gambuj Mosque-03

ঐতিহাসিকগণ মনে করেন, গম্বুজগুলো ৬০টি প্রস্তরনির্মিত স্তম্ভের ওপর অবস্থিত বলেই এর নাম ষাটগম্বুজ। আবার কেউ কেউ বলেন তিন মিটার লম্বা ৬০টি গম্বুজ আছে বলে এর নাম হয় ষাটগম্বুজ মসজিদ। বহু কাল ধরে এটিকে মানুষ ষাট গম্বুজ বলতে বলতে ষাট গম্বুজ নামেই পরিচিত হয়ে যায়।

মসজিদটি অনেক বছর সময় নিয়ে তৈরি করা হয়েছিলো এবং অর্থ খরচ করে নির্মাণ করা হয়েছিল। পাথরগুলো আনা হয়েছিল রাজমহল থেকে। কারো কারো মতে, খান জাহান আলী এই মসজিদটিকে নামাজের কাজ ছাড়াও দরবার ঘর হিসেবে ব্যবহার করতেন। আর এই দরজাটি ছিল দরবার ঘরের প্রবেশ পথ। আবার কেউ কেউ বলেন, মসজিদটি মাদরাসা হিসেবেও ব্যবহৃত হতো।

Shat Gambuj Mosque-04

লোকমুখে শোনা যায়, খান জাহান আলী বাগেরহাট এলাকায় ৩৬০টি মসজিদ এবং বহু দীঘি কেটেছিলেন। মসজিদটির পশ্চিম পাশে রয়েছে ঐতিহাসিক ঘোড়া দীঘি, যা দৃষ্টিনন্দন এ মসজিদের সৌন্দর্যকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রচলিত আছে, খান জাহান আলী এই দীঘিটি মেপেছিলেন ঘোড়ায় চড়ে। ঘোড়া যেখানে থেমে যায়, সেখানে গিয়েই তিনি মাপ বন্ধ করে দেন। সেখান থেকে এর নাম ঘোড়া দীঘি। আবার অনেকের বিশ্বাস, এখানে ঘোড়দৌড় হতো বলেই এর নাম ঘোড়া দীঘি। মূলত পানির সংকট দূর করতেই দীঘি খনন করেছিলেন খান জাহান আলী।

Shat Gambuj Mosque-05

ষাটগম্বুজ মসজিদের অদূরে অবস্থিত খান জাহান আলীর সমাধিসৌধ। খান জাহান আলী ও তার দেওয়ানের সমাধিসৌধের স্থানটি একটি দেয়াল দ্বারা বেষ্টিত। তার কবরের নিচে ইটের তৈরি দুটি স্তর করা হয়েছে । এ ইটগুলো দিয়ে ভিতরের সম্পূর্ণ মেঝে নানা বর্ণের ষড়ভুজী এবং বর্গাকার টালির নকশা করা । বর্তমানে দর্শনার্থীদের অনবরত ব্যবহার করার ফলে এই টালিগুলির আসল উজ্জ্বলতা নষ্ট হয়ে গেছে। এই পাথরের সমাধিসৌধে ব্যবহৃত লিপি থেকে এটা জানা যায় যে, খান জাহান আলী ২৭ জিলহজ ৮৬৩ হিজরিতে মৃত্যুবরণ করেন।