সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সংবর্ধনায় ভূষিত সাবিনা ইয়াসমিন

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় আয়োজিত সংবর্ধনায় সাবিনা ইয়াসমিনের ৭২তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন করা হয়। অনুষ্ঠানে তিনি জনপ্রিয় গান পরিবেশন করে দর্শক-শ্রোতাদের মুগ্ধ করেন।

সাংস্কৃতিক প্রতিবেদক
সাবিনা ইয়াসমিনকে সংবর্ধনা দিয়েছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়
সাবিনা ইয়াসমিনকে সংবর্ধনা দিয়েছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় |নয়া দিগন্ত

সংগীতের তাল, লয়, ছন্দের মাধুর্য ছড়িয়ে দেশের অগণিত মানুষকে সুরের সমুদ্রে নিমজ্জিত করেছেন কিংবদন্তি গানের পাখি সাবিনা ইয়াসমিন। মিষ্টি সুরের যাদুকরী কণ্ঠের কারণে দেশের কোকিলকণ্ঠী গায়িকা হিসেবেও নিজেকে সফলতার সর্বোচ্চ শিখরে উন্নীত করেছেন এই লিভিং লিজেন্ড। মায়াবী কণ্ঠের সুষমায় সংগীত অনুরাগীদের হৃদয় জয় করে শুধু নিজেকেই নয়, এদেশের সংগীতকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মাথা উচু করে তুলে ধরেছেন কোটি ভক্তের হৃদয়ের কম্পন গানের পাখি সাবিনা ইয়াসমিন। গত ৪ সেপ্টেম্বর ছিল সুরের রানীর ৭২তম জন্মদিন।

শিল্পীর জন্মবার্ষিকীকে স্মরণীয় করে রাখার লক্ষ্যে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়। ব্যবস্থাপনায় ছিল বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। গতকাল রোববার সন্ধ্যায় একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার মূল মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় এই আয়োজন।

‘শুধু গান গেয়ে পরিচয়’ শীর্ষক একক সংগীতানুষ্ঠান, নাচ, তথ্যচিত্র প্রদর্শনী, আলোচনা, সম্মাননা ও সংবর্ধনাসহ জমকালো আয়োজনে মুখর ছিল মিলনায়তন। শুরুতেই লেখক-রাজনীতিক বদরুদ্দীন উমরের মৃত্যুতে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এরপর প্রদর্শিত হয় শিল্পীর বর্ণাঢ্য জীবনের উপর নির্মিত তথ্যচিত্র। পরে শুরু হয় গানের আসর।

‘সুন্দর সুবর্ণ রূপসী লাবণ্য’ গানটির মধ্য দিয়ে সুরের ঝাঁপি খোলেন দেশীয় সংগীতের এই দিকপাল। এরপর একে একে পরিবেশন করেন ‘আমি রজনীগন্ধা ফুলের মতো’, ‘তুমি ফুলকে বলো ঝরে যেতে’, ‘শত জনমের ভাগ্য তুমি আমার জীবনে এলে’সহ তার ক্যারিয়ারের কালজয়ী ও জনপ্রিয় গানগুলো। তার সুরের মূর্ছনায় মিলনায়তনে ঢেউ খেলে যায়, দর্শক-শ্রোতারা বিমোহিত হন। প্রতিটি পরিবেশনার পর অনুরোধে সাড়া দিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে একের পর এক গান শোনান সাবিনা ইয়াসমিন।

এছাড়াও শিল্পকলা একাডেমির নৃত্যশিল্পীরা ‘গীতিময় সেই দিন চিরদিন আর এলো না’ গানের সাথে দলীয় নৃত্য পরিবেশন করেন।

অনুষ্ঠানের শুরুতে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ শিল্পীকে উত্তরীয় পরিয়ে দেন ও সম্মাননা প্রদান করেন। এসময় উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, মন্ত্রিপরিষদ সচিব শেখ আবদুর রশীদ, সংস্কৃতি সচিব মো: মফিদুর রহমান, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ ও শিল্পকলা একাডেমির সচিব ও দায়িত্বপ্রাপ্ত মহাপরিচালক মোহাম্মদ ওয়ারেছ হোসেন।

দেশবরেণ্য শিল্পীদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন খুরশীদ আলম, খন্দকার রফিকুল আলম, আবিদা সুলতানা, নকীব খান, আগুন, পার্থ বড়ুয়া প্রমুখ।

পরিকল্পনা বিষয়ক উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, বাংলা গান মানেই আবেগ, স্মৃতি আর হৃদয়স্পর্শী সুরের এক অনন্ত ভুবন। সেই ভুবনে যদি কারো কণ্ঠ অনায়াসে শ্রোতার হৃদয় ছুঁয়ে যায়, তবে তিনি নিঃসন্দেহে সাবিনা ইয়াসমিন। অর্ধশতকেরও বেশি সময় ধরে সংগীতের আকাশে তার কণ্ঠ ভেসে এসেছে, কখনো চলচ্চিত্রের পর্দাজুড়ে, কখনো বেতার-টেলিভিশনের সুরে, আবার কখনো মানুষের জীবনের মধুর সঙ্গী হয়ে।

স্বাগত বক্তৃতায় সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেন, যার গান শুনে শুনে আমরা সময়ের সাথে আগামীর পথে হেঁটেছি, যার গান প্রাণে শিহরণ এনেছে, আপ্লুত করেছে, অভিভূত করেছে- তিনি বাংলা গানের পাখি সাবিনা ইয়াসমীন। স্বনামখ্যাত এ গুণী শিল্পীকে সম্মাননা প্রদান করতে পেরে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় গর্বিত ও আনন্দিত।

অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন অভিনেতা ও নির্মাতা আফজাল হোসেন।

বরেণ্য কণ্ঠশিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন ১৯৫৪ সালের ৪ সেপ্টেম্বর এক সাংস্কৃতিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। সংগীতে হাতেখড়ি মায়ের কাছে। মাত্র ৬ বছর বয়সে ‘অল পাকিস্তান স্কুল মিউজিক কম্পিটিশন’-এ গান গেয়ে প্রথম হন। এরপর বিভিন্ন ছায়াছবিতে শিশু শিল্পী হিসেবে কণ্ঠ দেন। এ পর্যন্ত তিনি প্রায় ১৬ হাজার গান রেকর্ড করেছেন, যার বেশিভাগই চলচ্চিত্রের গান।

তার এ সফল যাত্রায় তিনি কাজ করেছেন সত্য সাহা, আলম খান, সুবল দাস, আলাউদ্দিন আলী, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, আরডি বর্মণ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, বাপ্পি লাহিড়ী, আলী হোসেনের মতো অসংখ্য কিংবদন্তি সুরকারের সাথে। একই সাথে তার কণ্ঠ মিলেছে মান্না দে, কিশোর কুমার, আশা ভোঁসলে, কুমার শানু, শ্যামল মিত্রসহ বহু শিল্পীর সাথে।

আধুনিক গান, পল্লীগীতি, রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলসংগীত, গজলসহ নানা ধারার গান গেয়েছেন। তিনি বেতার-টেলিভিশনের নিয়মিত শিল্পী এবং দেশে-বিদেশে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পরিবেশনা করেছেন।

১৯৮৩ সালে ভারতের বিশ্ব উন্নয়ন সংসদ তাকে ‘সংসদ রত্ন’ উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৮৫ সালে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করা হয়। তিনি একুশে পদক (১৯৮৪) ও স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৯৬) লাভ করেন। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ১৫ বার শ্রেষ্ঠ সংগীত শিল্পীর সম্মাননা পেয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন। দেশে-বিদেশে আরো বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন এই কিংবদন্তি শিল্পী।